প্রকৃতির ঐশ্বর্যে ঘেরা বলধা গার্ডেন



প্রস্তুতি: লাইফ স্টাইল (প্রতিমুহূর্ত.কম)

প্রকৃতির ঐশ্বর্যে ঘেরা বলধা গার্ডেনের অবস্থান পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। ১৯০৯ সালে তৎকালীন জমিদার এবং বিশিষ্ট প্রকৃতি প্রেমিক নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী এই বলধা এস্টেটস-এর প্রতিষ্ঠাতা।

 বর্তমানে বলধা গাজীপুর জেলার অন্তর্গত একটি অনুন্নত গ্রাম। অথচ বলধা এককালে ছিল একটি সমৃদ্ধ জনপদ। বিখ্যাত ভাওয়াল এস্টেটের পার্শ্ববর্তী একটি স্বতন্ত্র জমিদারী এস্টেট। বিংশশতকের গোড়ার দিকে উত্তরাধিকার সূত্রে এই এস্টেটের জমিদারী লাভ করেন নরেন্দ্র নারায়ণ। ভাওয়াল রাজাদের তুলনায় নরেন্দ্র নারায়ণের প্রভাব-প্রতিপত্তি কম হলেও ব্যক্তিগত গুণাবলীর কারণে তিনি ইতিহাসে স্থান করে নেন

এক সময়ে ভাওয়াল এস্টেটের আশেপাশে ছিল আরো কয়েকটি ছোট ছোট জমিদারী এস্টেট। সেগুলো হলো পুবাইল, গাছা, কশিমপুর বলধা। গাছার তৎকালীন জমিদার মহিমচন্দ্র ঘোষ ছিলেন বলধার জমিদার হরেন্দ্র নারায়ণের নিকটাত্মীয়। ভাওয়াল জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ছিলেন উভয়ের সাধারণ প্রতিপক্ষ। বলধার জমিদার হরেন্দ্র নারায়ণ নিঃসন্তান থাকায় গাছার জমিদার মহিম চন্দ্র ঘোষের পুত্র নরেন্দ্র নারাযয়ণকে দত্তক নেন।

নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর জন্ম বাংলা ১২৮৭ সালের আশ্বিন মাসে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বলধার জমিদার হরেন্দ্র নারায়ণ তাকে দত্তক নেন। হরেন্দ্র নারায়ণ দেহত্যাগ করলে বলধার জমিদারী স্বত্ব লাভ করেন নরেন্দ্র সময় বলধার জমিদারী ঋণভারে জর্জরিত ছিল। তরুণ নরেন্দ্র সে অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটান এবং ক্রমেই বিপুল অর্থের মালিক হন। 

বিংশ শতকের শুরুতে তিনি স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ঢাকায় চলে আসেন এবং ঢাকা থেকেই জমিদারী দেখাশোনা করতেন। ঢাকায় এসে তিনি তৎকালীন বলধা এলাকা ওয়ারীতে বাড়ি নির্মাণ করেন। বাড়ির নাম দেনকালচার হাউজ'। পরবর্তীকালে তাবলধা হাউজ' হিসেবে পরিচিতি পায়

বলধা গার্ডেন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিচিত্র বাগান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নানারকম বৃক্ষের সমারোহে সমৃদ্ধ। চমৎকার পরিবেশ, দুষ্প্রাপ্য সব গাছগাছালির সমারোহ, ইট-পাথরে ঘেরা জনাকীর্ণ ব্যস্ত নগরবাসীর কাছে যেন এক টুকরো স্বর্গোদ্যান। স্নিগ্ধ সবুজ আর নির্জনতা নিয়ে এই বাগান যেন ব্যস্ত নগরবাসীর কাছে দখিনা সমীরণ। 

এখানে ক্যামেলিয়া, স্বর্ণ অশোক, আফ্রিকান টিউলিপ, বিরল প্রকৃতির দেশি-বিদেশি ক্যাকটাস, অর্কিড, এনথোরিয়াম ভোজ্যপত্রসহ বিচিত্র রকম বকুল গাছ, আমাজান সিলি, রক্তজনা ইত্যাদি প্রায় আটশ' রকমের প্রজাতির গাছ রয়েছে। তবে সাইকি সিবলি অংশে দেশি-বিদেশি প্রায় ১৮ হাজার উদ্ভিদ সংগ্রহ সংরক্ষণ করা আছে।  

বলধা গার্ডেনের সিবলি অংশের প্রধান আকর্ষণ শঙ্খনদ পুকুর। এই পুকুরে রয়েছে ফুটন্ত শাপলা পদ্মফুল। এগুলো পাতা দেখলে মনে হয় যেন একেকটি বড় বড় বিছানা। শীতল পার্টির নরম বিছানার মতো। পুকুরের পানির রঙ বেশ স্বচ্ছ টলটলে। পুকুরের দুপাশে সান বাঁধানো ঘাট। সিঁড়ির ধাপগুলো চওড়া। একসাথে বেশ কয়েকজন বসে মাছের খেলা দেখা যায়

পুকুরের পাশেই বিখ্যাত হাউজ। ১৯২৬ সালে শেষবার ঢাকা সফরকালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাগিচাটি পরিদর্শনে আসেন। ক্যামেলিয়া ফুলের বিপুল সমারোহ দেখে এবং ক্যামেলিয়া ফুলের গন্ধে মুগ্ধ হয়ে এই হাউজে বসেই তিনি রচনা করেনক্যামেলিয়া' কবিতাটি।  

এই বাগানের আকর্ষণের যেন শেষ নেই।সূর্যঘড়ি' সেরকমই একটি। ঘড়িটি বাগানের প্রথম থেকেই চালু রয়েছে। সূর্যের সাথে তাল মিলিয়ে এই ঘড়ির সময় উঠানামা করে। দর্শণার্থীরা শক্মখনদ, জয় হাউজ এবং বিভিন্ন প্রজাতির গাছগাছালি দেখে মুগ্ধ হন। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন সূর্যঘড়ির দিকে

নরেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক এবং বৃক্ষপ্রেমিক। সাহিত্যেও ছিল তার আগাধ জ্ঞান। তিনি সারাজীবন সাহিত্য চর্চা করেছেন। বৃক্ষপ্রেমিক, সাহিত্যিক প্রকৃতিবিদ এই তিন স্তরের সমন্বয় ঘটেছিল জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরীর মধ্যে। আর এসব গুণের অনুভূতি প্রবণ হয়ে সাহিত্যিক নরেন্দ্র নরায়ণ চৌধুরী বাগানটিকে দুটি অংশে বিভক্ত করেন। এক অংশের নামসাইকি।' যার অর্থ আত্মা। আর দ্বিতীয় অংশের নামসিবলি।' যার অর্থ প্রকৃতির দেবী

বাগানটিতে বিভিন্ন সময়ে দেশি-বিদেশি বরেণ্য ব্যক্তিরা এসেছেন এবং নানা ধরনের বৃক্ষ রোপণ করেছেন। এদের মধ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্তসেন অন্যতম।  

১৯৪৩ সালে ১৩ আগষ্ট জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী দেহত্যাগ করেন। তার ইচ্ছানুযায়ী বলধা গার্ডেনে তার শবদাহ করা হয়। গভীর শ্রদ্ধায় তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী শুধু একজন সফল জমিদারই ছিলেন না, তার চরিত্রে বহু গুণের সমন্বয় অনুরাগী। চিত্রশিল্পী প্রথম পিয়াসী।  

তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হচ্ছে তিনি ছিলেন একজন বিদগ্ধ সংগ্রাহক এবং এক বড় মানের প্রকৃতিপ্রেমী। ওয়ারীর বাড়িটিকে তিনি একটি সংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত করেন। বাড়ির ভেতরে মঞ্চ নির্মাণ করে নাটক মঞ্চস্থ করতেন। নাটকের লেখক, পরিচালক নির্দেশক ছিলেন তিনি নিজে। নাটক ছাড়াও তিনি উপন্যাস, কবিতা গান লেখেন। তার অমর সৃষ্টি বলধা গার্ডেন। .৩৮ একর জমির উপর এই নয়নাভিরাম বাগিচাটি অবস্থিত

লেখা : আব্দুল্লাহ আল জুবায়ের, নিউজরুম এডিটর
এজে- ১৮/৫-৪


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সালাহ্উদ্দিন লাভলুর ধারাবাহিক নাটক 'কবুলীয়তনামা'

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ২টি গল্প

নাচো নাচো (রিমিক্স)