জনবল সংকট ও অব্যবস্থাপনায় ছাতক হাসপাতালের বেহালদশা


প্রস্তুতি : সারাদেশ (প্রতিমুহূর্ত.কম)

প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা, দূর্নীতি ও দূর্বল জনবল নিয়ে ৫ লক্ষাধিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান ছাতক হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। দায়িত্ব-কর্তব্যে চরম অবহেলার ফলে জনগুরুত্বপূর্ন এ প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে এক রকম ছিনিমিনি খেলে চলছেন সংশ্লিষ্টরা। হাসপাতালের সকল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে রয়েছে দায়িত্বে অবহেলা করার নানা অভিযোগ। 

ডাক্তারবিহীন চেম্বার, নোংরা পরিবেশ, রোগীদের নিম্নমানের খাবার পরিবেশন, বিছানাপত্রে অস্বাস্থ্যকর অবস্থা, অরক্ষিত হাসপাতাল, তীব্র ওষুধ সংকট, হাসপাতাল এলাকায় গো-মহিষের অবাধ বিচরণ ও সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বখাটেদের আনাগোনা এখানের নিত্যদিনের চিত্র। ফলে এ হাসপাতাল থেকে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া তো দূরের কথা, রোগীর সাথে আসা লোকজন উল্টো রোগী হয়ে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে। এসব একাধিক অভিযোগে স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত ছাতকবাসীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ বিরাজ করছে।

ছাতক, দোয়ারা ও কোম্পানীগঞ্জের একটি অংশসহ প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ছাতক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১৯৮৩ সালে ৩০ মে তৎকালীন স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী মেজর জেনারেল এম সামছুল হক আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ৩০ শয্যা বিশিষ্ট আধুনিক এই হাসপাতালটি প্রায় পূর্নাঙ্গভাবেই প্রতিষ্ঠা লাভ করায় এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার মতো দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা প্রতিষ্ঠিত হয়। আশানুরূপ না হলেও স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা পাওয়ার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয় ।

ডাঃ গোলাম মাওলা চৌধুরী টিএইচও হিসেবে এখানে দায়িত্ব গ্রহনের পর থেকে এ হাসপাতালের অনিয়মের স্বর্গরাজ্য পরিণত হয়। ডাক্তারদের মধ্যে শুরু হয় আসা-যাওয়ার প্রতিযোগিতা। ডাঃ গোলাম মাওলার কারনণই বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা এখানে বেশী দিন টিকে থাকতে পারেনা বলে অভিযোগ উঠেছে। বর্তমানে এ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা সেবা পাওয়া যাবে এমন বিশ্বাস আর মানুষের মধ্যে নেই। উপজেলা পরিষদের সমন্বয় কমিটির সভায় এ নিয়ে বার-বার আলোচনা হলেও হাসপাতালের চিত্র এতটুকু পাল্টেনি। 

এদিকে দুযুগ থেকে উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ফারুকুল ইসলাম অত্যন্ত দাপটের সাথে এখানে নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে সরকারি ওষুধ বিক্রি, হাসপাতালে দায়িত্বকালীন সময়ে গরীব রোগীদের কাছ থেকে অবৈধ টাকা আদায়, জখমি রোগীদের ইচ্ছে মতো মেডিকেল সার্টিফিকেট দিয়ে অবৈধ আয়-রোজগার করাও তার অন্যতম উৎস। 

গত বছরের ৮ ডিসেম্বর হামলার ঘটনায় আহত সোনারা বেগম (৩০) নামের এক রোগীনিকে নিয়ে হাসপাতালে এসে বাসা থেকে ডেকে আনার অপরাধে মেডিকেল এসিষ্ট্যান্ট ফারুকুল ইসলাম রোগীনির স্বামী হানিফ আলীকে গালিগালাজ সহ শারীরিক লাঞ্ছিত করেন এবং ১ হাজার টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা দেয়ার কথা জানান। এ ঘটনায় ৬ জানুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা পরিচালক, দূর্নীতি দমন কমিশনের মহা পরিচালক সহ বিভিন্ন দপ্তরে হানিফ আলী বাদী হয়ে ফারুকুল ইসলামের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এর আগে ইসলামপুর ইউনিয়নের সৈদাবাদ গ্রামের বাতির আলী নামের অপর এক ভূক্তভোগী গত বছরের ২৭ আগষ্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা পরিচালক বরাবরে ফারুকুল ইসলামের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। এরকম একাধিক অভিযোগ রয়েছে মেডিকেল এসিষ্ট্যান্ট ফারুকুল ইসলামের বিরুদ্ধে।  
 
সংশ্লিষ্টসূত্র থেকে জানা গেছে, ছাতক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৯টি পদের বিপরীতে বিভিন্ন বিভাগে ৪ জন ডাক্তার রয়েছেন। গাইনী বিভাগের কোন ডাক্তার এখানে নেই। ফলে প্রসূতি মায়েদের চিকিৎসাসেবার জন্য চরম দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। জরুরী বিভাগে দিনের বেলা মেডিকেল এসিষ্টেন্ট সিরাজুল ইসলাম ও ফারুকুল ইসলাম পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করলেও ডাক্তারদের পাওয়া এখানে ভাগ্যের ব্যাপার। মেডিকেল এসিষ্টেন্ট ফরুকুল ইসলাম দুযুগ ধরে এখানে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। সাধারন মানুষ তাকেই ডাক্তার বলে মনে করেই চিকিৎসা সেবা নিতে এসে বিভিন্নভাবে হয়রানীর শিকার হতে হচ্ছে। সন্ধ্যার পর জরুরী বিভাগে ওয়ার্ডবয় ছাড়া কোন ডাক্তার পাওয়া যায়না। রোগীরা এসে হৈ-চৈ শুরু করলে ওয়ার্ডবয়ের মাধ্যমে ডাক্তার অথবা মেডিকেল এসিষ্ট্যান্টদের কিছুক্ষণের জন্য ডেকে আনা হয়।  এছাড়া সুপারভাইজার সহ ১০টি সেবিকা পদের মধ্যে ৭টি পদই শূন্য রয়েছে। স্বাস্থ্য পরিদর্শক ৫ জনের মধ্যে ৩জন, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক ১৪ জনের মধ্যে ৬ জন এবং স্বাস্থ্য সহকারি ৭০ জনের মধ্যে ৬৪ জন কর্মরত রয়েছেন। 

ফার্মাসিষ্ট পদটি এখানে দীর্ঘদিন যাবত শূন্য রয়েছে। ডেন্টাল সার্জন থাকলেও যন্ত্রপাতির অজুহাতে তিনি বিনা শ্রমে সরকারী বেতন-ভাতা ভোগ করছেন নিয়মিত। টিউবওয়েল না থাকায় ভর্তিকৃত রোগীরা রুটিন করে দুবেলা বোতল দিয়ে পাম্পের পানি সংগ্রহ করতে হয়। পানির তীব্র সংকটের কারনে রোগীরা শৌচাগার ব্যবহার করছে নোংরা পরিবেশে। দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের জেনারেটর বিকল হয়ে পড়ে আছে। মেরামতের জন্য কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পুরুষ-মহিলা দুটি ওয়ার্ডেই বিরাজ করছে নোংরা পরিবেশ। বিছানাপত্র ব্যবহারের অনুপযুক্ত ও অস্বাস্থ্যকর। রোগীদের পরিবেশন করা হচ্ছে নিম্নমানের খাবার। রোগীদের খাবার ওয়ার্ডে এসে পরিবেশন করার নিয়ম থাকলেও এখানে তা মানা হচ্ছেনা। রোগীদেরকেই নীচতলার রান্নাঘর থেকে খাবার সংগ্রহ করতে হচ্ছে।   

হাসপাতালের টিএইচও ডাঃ গোলাম মাওলা চৌধুরী জানান, হাসপাতাল এখন খুব ভাল অবস্থায় রয়েছে। সরকারী ওষুধপত্র পর্যাপ্ত থাকায় রোগীদের নিয়মিত ওষুধ দেয়া হচ্ছে। ৩মাস অন্তর-অন্তর বছরে ৪টি এলটের মাধ্যমে সরকারী ওষুধ আসছে। আবার জরুরী প্রয়োজনে আবেদনের মাধ্যমে ওষুধ আনানো হয়।
 
ডাঃ গোলাম মাওলা চৌধুরীর বক্তব্যের সাথে হাসপাতালের বর্তমান অবস্থার কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনি নিজেই সরকারী বাসায় বসে প্রাইভেট রোগী দেখায় ব্যস্ত থাকেন। সেভলন, তুলা ও ব্যান্ডেজ ছাড়া আর কোন ওষুধ হাসপাতালে পায়নি। টোটা-ফাটাদের ব্যান্ডেজ করাই যেন এ হাসপাতালের একমাত্র কাজ। বিভিন্ন অজুহাতে প্রায় সব রোগীকেই সিলেটের রাস্তা দেখিয়ে দেয়া হয়। হাসপাতালের ৩০ শয্যার বেশির ভাগ শয্যাই খালি থাকে দিনের পর দিন। দুর-দূরান্ত থেকে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীরা তীর্থের কাকের মতো ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। 

রোগী দেখার জন্য নয়, ডাক্তাররা হাসপাতালের চেম্বারে বসেন ঔষধ কোম্পানীর প্রতিনিধিদের সময় দেয়ার জন্য। ডাঃ গোলাম মাওলা চৌধুরী হাসপাতালের চেম্বারে বসে প্রধান সহকারী আমিরুল হকের সাথে আলাপাচারিতায় সময় কাটান। ডাঃ গোলাম মাওলা চৌধুরী ও আমিরুল হকের প্রতি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহনকারী সাধারন মানুষের বিভিন্ন অভিযোগ। এমনকি হাসপাতালের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীও তাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন। স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনৈতিক সেল্টারে থাকায় আমিরুলের সাথে ডাঃ গোলাম মাওলা চৌধুরীর গড়ে উঠে সখ্যতা। আমিরুল হকের ইচ্ছে মতই বর্তমানে হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কেউ তাদের কাজের বিরোধিতা করলে তাকে বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগে শাস্তিমূলক অন্যত্র বদলি করে দেয়া হয়। 

টিএইচও এবং আমিরুল হকের কাজে যারা তাল মিলিয়ে চলতে পারে তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালন না করলেও কোন সমস্যা হয়না। এমন অনেকেই আছেন যারা দায়িত্ব পালন না করেই সরকারী বেতন-ভাতা ভোগ করে যাচ্ছেন মাসের পর মাস। তবে এক্ষেত্রে বেতন-ভাতার একটি অংশ তাদের দিতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ডাঃ গোলাম মাওলা চৌধুরীর প্রতি এমন একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এক কথায় ছাতকে যোগদানের পর থেকেই তিনি হাসপাতালকে ব্যাক্তিগত সম্পত্তিতে পরিনত করেছেন। আর এ সম্পত্তিকে ইচ্ছামত ব্যবহার করতে আমিরুল হককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ দুজনের কারনে ঐতিহ্যবাহী ছাতক হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা আজ দুমড়ে-মুচড়ে পড়েছে। ফলে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এ অঞ্চলের হাজার-হাজার মানুষ। সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে হাসপাতালকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ফিরে পেতে চায় এ অঞ্চলের ভুক্তভোগী মানুষ।


প্রতিবেদন : আনোয়ার হোসেন রনি, জেলা প্রতিনিধি, সুনামগঞ্জ । 
সম্পাদনা : সজল বি রোজারিও
এআর-২৬/৫-১  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সালাহ্উদ্দিন লাভলুর ধারাবাহিক নাটক 'কবুলীয়তনামা'

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ২টি গল্প

নাচো নাচো (রিমিক্স)