রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন ...

রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন

প্রস্তুতি : লাইফস্টাইল (প্রতিমুহূর্ত.কম/ protimuhurto.com)

রেগে যাওয়ার আরেক নাম হেরে যাওয়া, আর তাই বলা হয় `রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন'। রেগে গেলে মানুষ কীভাবে হেরে যায় তার একটি চমৎকার আমেরিকান গল্প আছে।

 এক মার্কিন ধনকুবেরের একমাত্র সুন্দরী কন্যা। কন্যার ছেলে-বন্ধুর কোনো অভাব নেই। অভাব থাকার কথাও নয়, একে তো সুন্দরী তারপর ধনকুবেরের মেয়ে। মেয়ের যখন বিয়ের বয়স হলো বাবা তাকে বললেন, এখন তো তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বলো তোমার কাকে পছন্দ। যাকে পছন্দ তার সাথেই তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করবো।

মেয়ে বললো, আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। কারণ সবাই বলে তারা আমাকে ভালবাসে। আমার জন্যে প্রয়োজনে জান দিয়ে দেবে।

বাবা চিন্তায় পড়ে গেলেন। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে বুদ্ধি বেরিয়ে এলো। মেয়ের সাথে আলাপ করে বাবা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন- প্রতিযোগিতা হবে। প্রতিযোগিতায় যে প্রথম হবে তাকেই মেয়ে বিয়ে করবে।


প্রতিযোগিতার দিন দেখা গেল শতাধিক যুবক সুন্দর পোশাকে পরিপাটি অবস্থায় ধনকুবেরের বাড়িতে এসে উপস্থিত। ধনকুবের সবাইকে বাড়ির সুইমিং পুলে নিয়ে গেলেন। সুইমিংপুলের পাশে সবাইকে দাঁড় করিয়ে বললেন, দেখো, প্রতিযোগিতা খুব সহজ। সাঁতার প্রতিযোগিতা হবে। সাঁতারে যে প্রথম হবে তার সাথেই আমার মেয়ের বিয়ে দেব। তবে সুইমিং পুলে ঝাঁপ দেয়ার আগে ভালো করে খেয়াল করো। পানির নিচে বহু কুমির অপেক্ষা করছে। আর এই কুমিরগুলোকে এক মাস ধরে কোনো খাবার দেয়া হয় নি।

ধনকুবেরের কথা শেষ হতে না হতেই দেখা গেল যে, এক যুবক পানিতে পড়ে চোখ বন্ধ করে দুই হাত পা নাড়ছে। কুমিররা কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই যুবক ভাগ্যক্রমে কিছুক্ষণের মধ্যেই সুইমিংপুলের ওপারে গিয়ে উঠেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতবাক। বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই ধনকুবেরের মেয়ে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো যুবককে। গভীর আবেগে তাকে বলল, তোমার মত বীরকেই আমি চাচ্ছিলাম। তুমিই আমার স্বামী হওয়ার একমাত্র উপযুক্ত।


এদিকে যুবক উত্তেজিত, সে ভীষণ রেগে গেছে । রাগে তার হাত-পা কাঁপছে। এক ঝটকায় মেয়েটিকে দূরে ঠেলে দিয়ে যুবক চিৎকার করে উঠল, ‘কোন হারামজাদা আমাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছিলো, তাকে আগে দেখে নেই।সুন্দরী স্ত্রী ও ধনকুবেরের সম্পদ ঐ যুবকের হাতের মুঠোর চলে এসেছিলো। ধাক্কা যে-ই দিক, সে সুইমিং পুল অতিক্রম করে সবার চোখে বিজয়ী বীর বলে গণ্য হয়েছিলো, কিন্তু শুধুমাত্র রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় সৌভাগ্য এসেও তা হাতের নাগালের বাইরে চলে গেল। অথচ রাগ দমন করতে পারলে, ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে পারলে সে অনায়াসে মুচকি হেসে বলতে পারতো, ‘পুরুষ তো আমি একাই, ওরা আবার পুরুষ নাকি!’ নিজের জীবন অনুসন্ধান করলেও আপনি হয়তো দেখতে পাবেন অনেক সুযোগ নষ্টের পিছনে রয়েছে আপনার রাগ, ক্ষোভ ও অভিমান। তাই সবসময় মনে রাখবেন,  ‘রেগে গেলেন, তো হেরে গেলেন’।
আমরা যখন রেগে যাই তখন  কোনকিছু চিন্তা না করেই এমন সব কথা বলে ফেলি বা কাজ করে ফেলি, যার  মাশুল গুণতে হয় পরে অনুশোচনা করে বা সুযোগ হাতছাড়া করে। আবার রাগ চেপে রাখাও ক্ষতিকর। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ জমিয়ে রাখছে তাদের বিষণ্নতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, বিষণ্নতা হলো চেপে রাখা ক্ষোভ। রাগ বা ক্ষোভ আসলে জীবনের আনন্দকেই কেড়ে নেয়।

অন্য যেকোনো আবেগের চেয়ে রাগের ফলে সম্পর্কের জটিলতাগুলো বেশি হয়। পরিবারের সদস্য, বন্ধু, আত্মীয়, প্রতিবেশী বা যেকোনো মানুষই একজন রাগী মানুষকে এড়িয়ে চলতে চায় এবং পছন্দ করে না।


আমরা যখন রেগে যাই আমাদের দেহে কিছু জৈব রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। যেমন, হার্টরেট, ব্লাড প্রেশার এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের হার বেড়ে যায়, ক্যাটাকোলামাইন নিউরোট্রান্সমিটার এবং অ্যাড্রিনালিন ও নর- অ্যাড্রিনালিন হরমোন নিঃসরিত হয় যা উত্তেজনা সৃষ্টি করে। দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায় ফলে ঘাম হয় এ তাপমাত্রাকে স্বাভাবিক করার জন্যে। পেশী সংকুচিত হয় এবং হাত-পায়ে রক্ত চলাচল বেড়ে যায় যেকোনো দৈহিক তৎপরতাকে পরিচালনা করার জন্যে। অর্থাৎ ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স সক্রিয় হয়ে ওঠে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দীর্ঘসময় ধরে যদি এই রেসপন্স চলতে থাকে তাহলে অনেক ধরনের ক্রনিক রোগ হতে পারে। যেমন, ইনসমনিয়া, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, আলসার, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, মৃগীরোগ, কোষ্ঠকাঠিন্য, মাইগ্রেন, ব্যাকপেইন, ফুসফুসের অসুখ এমনকি ক্যান্সার।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, রেগে যাওয়ার প্রবণতা বেশি এমন ব্যক্তিরা তাদেও বয়স ৫৫ বছর হওয়ার আগেই অন্যদের তুলনায় হার্ট অ্যাটাকে বেশি আক্রান্ত হন। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স্ক পুরুষদের ক্ষেত্রে কোলেস্টেরল, অ্যালকোহল, সিগারেট বা অতিরিক্ত ওজনের চেয়েও হৃদরোগের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক পাওয়া গেছে রেগে যাওয়ার প্রবণতার।

এমনকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং আয়ুস্কালের ওপরও রাগের প্রভাব আছে। বদরাগী বা রগচটা মানুষ বলে পরিচিতদের মৃত্যুর হার ৫ গুণ বেশি।

আপনি যদি সত্যিই মনে করেন যে রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন, তাহলে সত্যিই আপনি এ সমস্যা থেকে মু্‌ক্তি পাবেন। রাগ কমাতে, নয়তো জীবনে হার ঠেকানো যাবে না। এই হার ঠেকাতে রাগ কমাতে পারেন চটজলদি কিছু ব্যায়ামেও। এতে মাথায় ভেতরে নানান রাসায়নিকের সিক্রেশন হতে থাকে। যার ফলে আপনার মন হয় ভালো, মেজাজ সহজে বিগড়ে যায় না।

চিকিৎসকরা বলছেন, রাগে গা রি-রি করছে এমন অবস্থায় সবার আগে নিতে থাকুন দীর্ঘনিঃশ্বাস… প্রয়োজনে ১ থেকে ১০০ গুনে ফেলুন। হয়ে গেলে আবার রিপিট করতে থাকুন।

রাগের পারদ চড়ছে, এমন সময় থেকেই নিজের মনে আওড়াতে থাকুন “আমি রেগে যাব না”।
পজিটিভ পথে বক্তব্য প্রকাশের চেষ্টা করুন।

রাগের মাথায় হুট করে কিছু বলার আগে ভাবুন, নিজেকে মনে মনে ভাবান। কোনও কথা বলার আগে মনে মনে সাজিয়ে নিন। রাগের কারণ যাই হোক না কেন, চিৎকার না করে কোনওরকমের উগ্র আচরণ না করে পরিস্থিতি হাতের বাইরে যেতে না দিয়ে ক্ষমা করে দেওয়ার চেষ্টা করুন।

যে পরিবেশে আপনার রাগ-উত্তেজনা বাড়ছে, তেমন জায়গা দ্রুত পরিত্যাগ করুন। এতে আপনার প্রেশার কাবুতে থাকবে। পরিস্থিতিও।

আপনার মনে জমা হতাশা-ক্ষোভ-উত্তেজনা যথাযথ হোক বা না হোক, পরিস্থিতিকে হাল্কা করতে মজা করে সামাল দিন। বিপক্ষকে অভিযোগ না করে, প্রত্যেকটি বাক্যই নিজের ভুল হয়েছে ভেবে শুরু করুন। ‘তোমার জন্য এটা আমি ভুল করলাম’ বা, ‘করতে পারলাম না’ না বলে বলতে পারেন ‘আমার ভুল বোঝার কারণেই মনে হয় ভুলটা হল’।

সহজ এইসব টোটকা দিয়ে আপনার রাগকে বেড়ি না পরাতে পারলে মগজে খাটান ‘ইহং রাগাং ধ্বংসানিং’।

আর বুদ্ধিমানের কাজ হলো সত্যি রাগ না করে, বরং কপট রাগের অনুরণনে প্রিয়জনের হৃদয়ে লাগান আলতো অনুরাগের ছোঁওয়া!

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সালাহ্উদ্দিন লাভলুর ধারাবাহিক নাটক 'কবুলীয়তনামা'

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ২টি গল্প

নাচো নাচো (রিমিক্স)