অস্থীরতা মুক্ত জীবনের জন্য মেডিটেশন

অস্থীরতা মুক্ত জীবনের জন্য মেডিটেশন

প্রস্তুতি : লাইফস্টাইল (প্রতিমুহূর্ত.কম/ protimuhurto.com) ---

যাপিত জীবনের নানা জটিলতায় আমাদের মন জুড়ে প্রায়ই বয়ে যায় অস্থীরতার ঝড়। কাছের মানুষের স্বার্থপরতা আর অকৃতজ্ঞতায় মনে ভর করে তীব্র ক্ষোভ আর হতাশা। কোনো কাজে মন বসে না। জগৎ সংসারের সবকিছু হয়ে রূপহীন, বিবর্ণ আর বিরক্তিকর। তোলপাড় করা মনে প্রশান্তি এনে দেবার অনন্য উপায় হলো মেডিটেশন।


আমাদের স্বপ্নপ্রবণ মন যে জীবনের আকাঙ্ক্ষা করতে শেখায়, চেষ্টার অভাব অথবা দুর্ভাগ্য যে কারণেই হোক না কেন, বাস্তবের সঙ্গে তার সৃষ্টি হয় আকাশ-পাতাল ব্যবধান। এই উপলব্ধিটা যখন হঠাৎ আমাদের জীবনের দুঃসহ বোঝা হয়ে নেমে আসে তখন যেন আমরা তার ভারে নুয়ে না পড়ি, এ জন্যই দরকার মনের জোর।

যে কোনো পরিস্থিতিতেই সবার আগে মেনে নিতে হবে বাস্তবতাকে। বাস্তবতা মেনে নিতে পারলে মনের মধ্যে জমাট বাঁধা অনেক বোঝা নেমে যাবে। পাশাপাশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে যে চেষ্টার অভাব, নিষ্ক্রিয়তা, স্বপ্ন-বিলাসিতা এবং কল্পপ্রবণতার কারণে এত সমস্যা (সমস্যা বলতে মানসিক এবং বৈষয়িক দুটোই) সৃষ্টি হয়েছে ভবিষ্যতে যেন তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন হয়ে সচেষ্ট হতে হবে।

নিজের প্রত্যাশা বা ইচ্ছে বিরুদ্ধে কিছু ঘটে থাকলে তার জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এ সময়ে কোনো সুখের অনুভূতি সৃষ্টি হলে তাকে যতক্ষণ সম্ভব প্রলম্বিত করতে হবে। কারণ তাতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবচেতন মনের শুশ্রূষা হবে। একটা বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে, তার যোগ্যতা এবং অযোগ্যতা উভয় দিকই, তবে ভেবে ভেবে হয়রান হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

সমস্যা আছে, সমস্যার সমাধান করতে হবে, কিন্তু তাই বলে নিজেকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে মনকে শাস্তি দেয়ার মতো অর্থহীন বোকামি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। সবচেয়ে বড় উপায় হলো প্রতিমুহূর্তের কাজ প্রতি মুহূর্তে করতে হবে, মস্তিষককে সচল রাখতে হবে। অলস মস্তিষেকই দুশ্চিন্তার পোকারা বেশি কিলবিল করে।

আমরা প্রতিটি মানুষই জন্মগতভাবে উত্তরাধিকারসূত্রে এমন কিছু মানসিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করি যা হাজার চেষ্টাতেও সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব নয়। সুতরাং এগুলোকে মেনে নেয়াই ভালো। আধুনিক মনস্তত্ত্ববিদরা মানুষেরর মনোজগতের এই বিষয়টিকে সার্থকভাবে উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন। আমরা তো জানি আমাদের মনের তিনটি অংশ- সচেতন, অবচেতন এবং অচেতন; আর এটি হলো যৌথ অবচেতনা।

এত সব কিছু সম্পর্কে সচেতনতা অর্জনের পরও বাস্তবতার চাপে মস্তিষ্ক মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে পড়বেই। আর সেই ক্লান্ত মস্তিষ্ককেই পুনরায় সজীব এবং প্রাণবন্ত করে তোলার প্রয়োজনেই মেডিটেশনের গুরুত্ব। মেডিটেশনের ফলে মস্তিষেকর ভেতর অসংখ্য নিউরন কার্যকর ও সক্রিয় হয়ে ওঠে, ফলে মানসিক প্রশান্তির পাশাপাশি গড়ে ওঠে প্রবল আত্মবিশ্বাস। এটাকে এক কথায় বলা যায় মানসিক ব্যায়াম। 


চলতি জীবনের জটিলতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হলে অবশ্যই মানসিক ব্যায়াম হয়ে সব মানুষের প্রতিদিনের জীবনের চর্চার অংশ হওয়া উচিত। আসলে মনের প্রশান্তির জন্য মেডিটেশন চর্চার জুড়ি নেই।

সবার জন্য খুব সহজে মেডিটেশন করার উপায় বলছি।

শিথিলায়ন :

মেডিটেশনের প্রথম ধাপ হলো শিথিলায়ন। মেডিটেশন বা শিথিলায়নের জন্য শুরুতেই একটা নিরিবিলি কামরা বেছে নিতে হবে। যেটা হতে পারে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা রাত যে কোনো সময়। তবে রুমটা হতে হবে নিরিবিলি-নির্জন-অন্ধকারময় এবং কোলাহলমুক্ত। বিছানার ওপর দুপাশে হাত রেখে লম্বালম্বিভাবে শুয়ে ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করতে হবে। এবার ধীরে ধীরে লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে শ্বাস ছাড়তে হবে, এভাবে সাতবার বা দশবার। মুহূর্তেই অস্থিরতা অনেকখানি কেটে যাবে। এবার ভাবতে হবে ইহলৌকিক জগতের ঊর্ধ্বে এক অপরূপ অপার্থিব জগতে যেন আমি প্রবেশ করেছি।

কোনোক্রমেই বাস্তব জীবনের কোনো পঙ্কিলতা বা আবিলতাকে মনের মধ্যে স্থান দেয়া চলবে না। অর্থাৎ নামাজ পড়ার সময়ে যেমনটি ঘটে থাকে, নিজেকে সেইরূপ উচ্চতায় তুলে ধরতে হবে। এরপর আমার চিন্তা-চেতনা, ভাবনা-কল্পনার সবকিছুকে কেন্দ্রীভূত করব আমার মস্তিষেক (২ মিনিট) [রক্ত চলাচল শুরু হয়ে যাবে], অতঃপর কপালে (২ মিনিট), এক ধরনের শিরশির অনুভূতির সৃষ্টি হবে। অতঃপর ভুরু যুগল, চোখ-নাক-ঠোঁট ক্রমে ক্রমে এই প্রত্যঙ্গগুলো শিথিল হয়ে আসবে। এরপর গলা, বুক, বুকের ভেতর ফুসফুস, দুই হাত, অতঃপর দুই পা। প্রাথমিকভাবে প্রত্যঙ্গগুলো শিথিল হলো।

সুখানূভুতি তৈরি :

এবার ভাবতে হবে সম্পূর্ণ শরীরটা যেন হাল্কা হয়ে গেছে এবং আমি রয়েছি মহাকাশের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মাঝখানে, অর্থাৎ আমার শরীরটা ধীরে ধীরে নিচের দিকে অবনমিত হচ্ছে; এভাবে কিছুক্ষণ। এবার ভাবতে হবে আমি শুয়ে আছি যেন বিশাল এক মরুভূমির (অবশ্যই ছায়াশীতল) মাঝখানে। সময়টা রাতের বেলা, জ্যোৎস্নাময়, চারদিকে অলৌকিক চাঁদের আলো। ধীরে ধীরে মাথা থেকে পা পর্যন্ত সম্পূর্ণ শরীর বালিতে রূপান্তরিত হলো। তারপর হঠাৎ এক ঝড়ো হওয়া এসে সেই বালির সতূপকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। তাহলে থাকল আর কি, কিছুই থাকল না, থাকল শুধু শূন্যতা। অসীম শূন্যতা। আর শুধু চেতনা। দেহহীন চেতনা নিয়ে আমি বেঁচে আছি। এভাবে কিছুক্ষণ তারপর ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ গুণে পরবর্তী স্তরে যাব।

এ স্তরে গিয়ে ভাবব আমার সমগ্র অস্তিত্বজুড়ে যেন শুধু নীল আলোর স্রোত। আর আমি সেই নীল আলোর স্রোতে ভেসে চলেছি। অদ্ভুত এক সুখানুভূতিতে ছেয়ে যাবে সারা তনুমন। এটাকে বলা হয় মস্তিষেকর আলফা লেভেলের প্রাথমিক স্তর। সম্পূর্ণ আলফা লেভেলে প্রবেশ করলে মন সব ধরনের কথা শোনার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। নীল আলোর সুখানুভূতিতে কিছুক্ষণ ভেসে থাকার পর আবার ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ গুনে প্রবেশ করব ‘মনের বাড়িতে’ বা এটাকে বলতে পারি মনের ড্রইংরুম। এখানে এসে মন সম্পূর্ণ আলফা লেভেলে প্রবেশ করবে।

ইচ্ছে-স্বাধীন মনের বাড়ি

মনের বাড়িকে সাজাতে হবে নিজের মনের মতো করে। সেটা হতে পারে এরকম- একটা বিশাল দীঘি, যার পানির রঙ নীলচে সবুজ। দীঘির ঠিক মাঝ বরাবর একটি বিশাল ডেইজি ফুল, তার আশপাশে দীঘিভর্তি লাল-নীল পদ্মফুল ইতস্তত ছড়ানো। দীঘির চারপাশে ঘিরে আছে বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ। লাল-নীল, সবুজ, বেগুনি বিভিন্ন রঙের ফুল ফুটে আছে গাছগুলোতে। মূলত একটি বিশাল অরণ্যের মাঝখানে এই দীঘির অবস্থান। যেই অরণ্যে নানা ধরনের পশুপাখির বিচরণ। অনতিদূরে তুষারধবল পাহাড়, সেখানে শ্বেত ভল্লুকের অবাধ বিচরণ। অথবা মনের বাড়ি হতে পারে সমুদ্র সৈকতের কোনো অপরূপ দৃশ্য, কিংবা সমুদ্রের অতল তলদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এটা নির্ভর করে ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব পছন্দের ওপর।

মনের বাড়িতে প্রবেশ করে যেটা করতে হবে তা হলো যে কোনো একটা সুখানুভূতি নিয়ে ভাবতে হবে। কিংবা মনের বাড়িতে বসে কোনো সুখের স্বপ্নও দেখে নেয়া সম্ভব। যাই হোক মনের বাড়িতে বসে নিজের মনকে সম্পূর্ণ তৃপ্ত করে মনে মনে উচ্চারণ করতে হবে আমি সুখী, আমি সুখী, আমি সুখী... যেন অনন্তকাল ধরে এই উচ্চারণ। এরপর আবার সংখ্যা গুনে যেতে হবে পরবর্তী স্তরে। এ স্তরে এসে নিজের ভেতরের বিভিন্ন দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য একটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা দরকার। যেমন- আমার যদি সমস্যা হয় ভীরুতা, অন্যমনস্কতা, অলসতা, অনিশ্চয়তা, দোদুল্যমানতা, সিদ্ধান্তহীনতা ইত্যাদি। তবে মনে মনে একটি ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে ওইসব শব্দ লিখে ব্ল্যাকবোর্ড ভর্তি করে ফেলব। অতঃপর ডাস্টার দিয়ে ওইসব নেতিবাচক শব্দ মুছে ফেলব। অর্থাৎ মন থেকে মুছে গেল সব ধরনের অনিশ্চয়তা।

অটোসাজেশন

এবার ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ গুনে প্রবেশ করতে হবে শিথিলায়ন প্রক্রিয়ার একেবারে চূড়ান্ত এবং শেষ স্তরে। এ স্তরে এসে যেটা করতে হবে তা হলো অটোসাজেশন। অর্থাৎ নিজেকে নিজে পরামর্শ দেয়া। যেহেতু মনের বাড়িতে এসে মন সম্পূর্ণভাবে আলফা লেভেলে প্রবেশ করেছে, সুতরাং মন এখন সম্পূর্ণভাবে শিথিলায়িত। মনের এই অবস্থায় মনকে যা বলা হবে মন তা শোনার জন্য সম্পূর্ণভাবে আগ্রহী এবং প্রস্তুত এবং এখন মনকে যা বলা হবে, পরবর্তী সময়ে অবচেতনভাবে মন তা পালন করে যাবে। সুতরাং ‘অটোসাজেশন’ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ধরা যাক, আগামীকাল এক বিয়ে বাড়ি নেমন্তন্ন রক্ষা করতে যাব। সমস্যা হলো কোথাও কোনো অনুষ্ঠান হলে আমি সেখানে মানুষের সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারি না। প্রাণবন্ত হতে পারি না। এক্ষেত্রে ‘অটোসাজেশন’ এনে দিতে পারে আপনার আত্মবিশ্বাস। মনছবি আঁকতে হবে। মনে মনে কল্পনা করতে হবে আমি চমৎকার নীল রঙের শাড়ি পরে মুখে ঝলমলে হাসি নিয়ে অনুষ্ঠানে গিয়েছি। সবার সঙ্গে সহজভাবে মিশছি, কথা বলছি। সবাই প্রশংসাসূচক দৃষ্টি দিয়ে আমাকে দেখছে। আমি যেন সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হয়ে উঠছি। অপূর্ব এক অনুভূতি।

মনছবিতে আপনি যে দৃশ্য আঁকলেন পরবর্তী দিন দেখবেন সত্যি সত্যি ঠিক তাই ঘটছে। এ এক বহুচর্চিত সত্য। মনছবি আঁকা হয়ে গেলে নিজের জীবনটা নিয়ে একটু পর্যালোচনা করে নিতে পারেন। কোথায় কী ভুল, ভুল সংশোধন করে কীভাবে সামনের দিকে এগোনো যায়, যে ব্যাপারে একটা পরিষকার চিত্র এঁকে নিতে পারেন। বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন ঘটতে বাধ্য। অতঃপর নিজের মধ্যে যেসব গুণের ঘাটতি আছে সেইসব গুণ নীরবে এবং জোরালো ও সপষ্টভাবে উচ্চারণ করুন। যথা বাস্তববাদী হব, কর্তব্যপরায়ণ হব, আত্মবিশ্বাসী হব, সুখী হব, দৃঢ়চেতা হব, সুস্থ হব, সুন্দর হব, আনন্দময় হব, প্রাণবন্ত হব, স্বতঃস্ফূর্ত হব, স্মার্ট হব, সাহসী হব, বলিষ্ঠ হব এবং অবশ্যই ব্যক্তিত্ববান হব।

এভাবে একান্ত নিবিড় অনুশীলনের পর ‘অটোসাজেশন’ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হলে ১ থেকে ২০ পর্যন্ত গুনে ধীরে ধীরে চোখ মেলতে হবে। দেখবেন এক নতুন সুন্দর এবং প্রাণবন্ত ‘আমি’ কে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। তবে মেডিটেশনের মোটামুটি সার্থক সুফল পেতে হলে তা ১ দিন/৭ দিন বা ১ মাসের অনুশীলনে সম্ভব নয়, অনুশীলন করে যেতে হবে মাসের পর মাস। এটাকে করে তুলতে হবে দৈনন্দিন জীবনের অনিবার্য অংশ। প্রতিনিয়ত আপনি আপনার উন্নতি লক্ষ্য করবেন। হয়ে উঠবেন একজন সুখী, সমৃদ্ধ এবং আত্মবিশ্বাসী মানুষ।  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সালাহ্উদ্দিন লাভলুর ধারাবাহিক নাটক 'কবুলীয়তনামা'

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ২টি গল্প

নাচো নাচো (রিমিক্স)