রোমহর্ষক গল্প : এফডিসির চার নম্বর ফ্লোরে

এফডিসির চার নম্বর ফ্লোরে

(একটি রোমহর্ষক গল্প )

 লতিফা লতা

 

 প্রস্তুতি : সাহিত্য (প্রতিমুহূর্ত.কম/ protimuhurto.com) ----

আমি একজন অভিনেতা। নাহ, কেউকাটা কেউ নই। অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিতে চাইছি। কিন্তু সুবিধা করতে পারছি না। আপাতত সাইড ক্যারেকটার করেই আমাকে খুশি থাকতে হচ্ছে। আজকেও এসেছি শুটিংয়ে। একটা হরর ফিল্মে কাজ করছি।

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার- মাঝে মাঝে খানিকটা কৃত্রিম আলো। ঝিঁঝিঁ পোকার কৃত্রিম ডাক। আর কোন সাড়াশব্দ নেই- এমন একটা পরিবেশে অনেক দূর থেকে শোনা গেল - 'লাইট -ক্যামেরা-অ্যাকশন'।

আমি যেখানে শুয়ে আছি সেখানে শোয়ানো আছে আমার মত আরো তিনজন অভিনেতা। আমি সহ মোট অভিনেতা চারজন। এই হরর ফিল্মটার শুটিং হচ্ছে এফডিসিতে- চার নম্বর ফ্লোরে। টিভিনাটকে অভিনয় করলেও ফিল্মে আমি নতুন। ফিল্ম    লাইনে টাকাপয়সা বেশি, তাই এখন এ লাইনেই জোর দিচ্ছি। এর আগে একটা হরর ফিল্মে অভিনয় করেছি মাত্র- তাও একটা লাশের ভুমিকায় মিনিট দুয়েক অভিনয়।

আমি কোন কাজও পাচ্ছিলাম না মনের মত। আমি এর আগের অভিনয়ের জন্য বেশ ভাল একটা রোল পেয়েছিলাম। কিন্তু গোলমাল বাঁধে একদম শেষে গিয়ে। আমি ভুল করে লম্বা একটা শর্টের একদম শেষ তিন সেকেন্ড আগে শ্বাস নিয়ে ফেলি। কেঁপে ওঠার জন্য আমার এই শর্টটাই বাদ দিয়েছিলেন আগের ছবির পরিচালক- কারণ এর আগে প্রায় ১০ মিনিটের শর্ট নেই হয়ে গিয়েছিল এবং তাতে খরচ হয়ে গিয়েছিল প্রায় দুই লাখ টাকার কাছাকাছি। তাই আমাকে একদম একটা বাজে মরার পার্ট করতে দেন করুনা করে। এই একটা পার্টের জন্য আমাকে বর্তমান ছবির পরিচালকের কাছে ধরনা দিতে হয়েছে অনেকবার।

হাতে পায়ে ধরে এডভান্স টাকা না নেবার শর্তে আমি রাজি হই, এবারের এই মরার ভূমিকায় অভিনয় করতে। কোন কারণ আমার ভুল হলে টাকা দেবেন না আমাকে এইশর্তে আমি এখন শুয়ে আছি। এই ফ্লোরের নকল স্টেজের একপাশে একটা কফিনের সাথে হেলান দিয়ে।




অনেক বার অনুরোধের পর এই রোল আমি পেলেও এতে অনেক রিস্ক ছিল। তাই শরীরে একটা ইঞ্জেকশন নিতে হয়েছে আমার সকল পেশিকে ঘণ্টা খানেকের জন্য অলস করে দেওয়ার জন্য। ইঞ্জেকশন নেবার পর প্রায় মিনিট বিশেক কেটে গেছে। এর মাঝে আমার হার্ট বিট কমে দাড়িয়েছে মোটে ৩০ এর ঘরে। খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছি আমি। নিচ্ছি না- নিতে বাধ্য হচ্ছি। কারন আমি মরার মত পড়ে আছি চারটা ক্যামেরার সামনে।

শর্ট টেক শেষ হলেই আমাকে আরেকটা ইনজেক্ট করে ঠিক করে দেয়া হবে- এমনটাই বলেছেন ছবির পরিচালক ইরফান সাহেব।

আমি প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু শেষে চিন্তা করলাম- ফিল্ম লাইন নতুন আমি। এই লাইনে টাকাও বেশি। তাছাড়া বেশ টানাটানির মদ্ধে আছি। কিছু টাকা পেলে এই মাসটা খানিকটা শান্তিতে কাটবে। কাজটা না পেলে আমার আগের খারাপ রেকর্ডের কারনে আমাকে না খেয়ে থাকতে হবে প্রায় সারা মাস। এর চেয়ে কয়েক ঘণ্টায় হাজার দশেক টাকা পাওয়া যাবে ভেবে এই লাশের ভূমিকায় আমি পড়ে আছি। দেখতে হয়তবা সত্যিকারের লাশের মতই লাগছে আমাকে।

শর্টটা ছিল এরকম যে কিছু লাশ পড়ে থাকবে এদিক সেদিক। একটা টেবিলে অনেক গুলো অস্ত্র থাকবে- যেমন চাপাতি ছুড়ি ইত্যাদি। এর মাঝে একজন কসাই এসে লাশগুলো কাটতে শুরু করবে।


আমাকে পরিচালক অভয় দিয়েছিলেন এই বলে যে, এই কসাইয়ের ভুমিকায় তিনি নিজে অভিনয় করবেন। উনি আমাকে কথাটা বলে উপরে বেশ গর্ভবোধ করলেও ভেতরের খবর হল -ডামি হলেও কোন লাশের হাত পা কাটতে কেউ রাজি হয়নি। উনার বাজেটও এমন নেই যে কেউ সেধে এসে রাজি হবে। অনেকটা আমার মতই তিনিও ঠেকায় পড়ে বা খরচ বাঁচাতে নিজেই অভিনয় করতে যাচ্ছেন।

উপরে উপরে খুশি হলে ও ভেতর ভেতর কেমন যেন ভয় পাচ্ছিলাম-কারন শক্তিমান অভিনেতা শাকের খান পর্যন্ত এই ছবিতে অভিনয়ের অফার ফিরিয়ে দিয়েছেন, এতে বাজেট খুব কম বলে। আর শাকের খানের মত অভিনেতার কি দায় পড়েছে যে উনি একটা কসাইয়ের ভূমিকা করবেন- তাও সব অখ্যাত মানুষের ভিড়ে? তাই কাউকে রাজি করাতে না পেরে শেষে নিজেই শুরু করলেন অভিনয় পরিচালক ইরফান সাহেব।


অ্যাকশন শব্দ শোনার কিছুক্ষন পর অভিনয়ের এলাকায় প্রবেশ করল কসাই। কিন্তু ইরফান খানকে ছাপিয়ে গেছে কসাইয়ের অভিনয়। আর মেকআপ এত ভাল হয়েছে যে আমিই চিনতে পারছি না। বয়স এক লাফে ৪৫ থেকে নেমে এসেছে ২৫ এর কোঠায়।

আমি আগেই বলে রেখেছিলাম ইরফান খানকে যে আমি লাশের ভুমিকায় অভিনয় করলেও চোখ খোলা রাখবো। প্রথমে গাইগুই করলেও পরে রাজি হন তিনি দুই ডোজ ঔষধ ইঞ্জেকশন দেবেন এই শর্তে। মেকআপ রুম থেকে লাশের মেকআপ আর কস্টিউম পড়ে যখন উনার রুমে গেলাম তখন উনি মাত্র মেকআপ নিচ্ছেন।

আমি যাওয়ার পর তিনি নিজেই আমার হাতে ইনজেকশন দিলেন। এটা পুশ করা মাত্রই মনে হয়েছে আমার শরীরের একটা পেশীও কোন কাজের না। সব যেন একটা একটা করে ঘুমিয়ে পড়েছে।

আমি এক অ্যাসিস্ট্যান্টের হাত ধরে কোন মতে স্টুডিওতে আসি। সেই থেকে আমি শুয়ে আছি এই কাঠের বাক্সের উপর। কোনরকমে চোখ মেলে তাকাতে পারছি। মস্তিষ্ক কাজ করছে- কিন্তু অনেক কিছু বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। কানে ভালই শুনতে পারছি। বস্তুতই একটা লাশের মত অবস্থা আমার। শুয়ে আছি তো আছি-ই। চলছে ক্লান্তিকর অপেক্ষা। ভৌতিক পরিবেশ বেশ ভালভাবেই জমিয়েছে ইরফান খানের স্টেজ শিল্পীরা।

চারপাশে ধোঁয়া ধোঁয়া অন্ধকার। একটা হালকা আলো ছড়িয়ে পড়েছে আমিসহ তিন লাশের ডামির উপর। আর কোন আলো ছিলনা। আর এখন আরেকটা লালচে আলো  ইরফান খানের উপর। ইরফান খানের পোশাকটাও সেই রকম ভয়ঙ্কর। মনে হচ্ছে কোন এক ইংরেজি মুভি থেকে ঊঠে এসেছেন মৃত্যুপুরীর কসাই। বেশ পরিণত মেকআপ।

সেটে এসেই নিপুন অভিনয় শুরু করে দিয়েছেন ইরফান খান। একটা টেবিলের উপর সাজানো ছিল নানারকম অস্ত্র ও সরঞ্জাম। সেখান থেকে একটা চাপাতি তুলে নিয়ে নিখাদ কসাইয়ের মত ধার পরীক্ষা করলেন চোখ দিয়ে। তারপর টেবিলে রাখা একটা ডামির পায়ের নিচ দিক থেকে কাটতে শুরু করলেন। বাহ কি নিপুন অভিনয়। যেন ইরফান খানের জন্মই হয়েছে কসাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য।

সেটে সুনসান নিরবতা। শুধু কসাইইয়ের একটানা থপথপ মাংস কাটার শব্দ শোনা যাচ্ছে। টেবিলের উপর রাখা একটা কাটা পা কে কেটে পাঁচ টুকরা করলেন কসাই সাহেব।যে এই হাড় বানিয়েছে তার জুড়ি মেলা ভার।আমি দশ হাত দূর থেকে হাড়ের সাদা অংশ আর চুইয়ে পড়া রক্তের মাঝে লালচে মাংস দেখতে পাচ্ছি। আজ থেকে ইরফান সাহেবকে কসাই নামেই ডাকবো আমি। অন্তত আমি এই অভিনয় করতে পারতাম না। একবার ও কাট না বলে এভাবে একটানা অভিনয় করা সহজ কথা না।

উফ আর পারলাম না। চোখের পাতা প্রথমবারের মত বন্ধ করে আবার খুললাম আমি এবং সাথে সাথে ভয়ঙ্কর ভাবে কসাই আমার দিকে তাকাল। এই প্রথম মনে হল এ চোখ ইরফানখানের চোখ নয়। আমি ইরফান সাহেবকে ভালভাবেই চিনি। ইনি ইরফান খান হতেই পারেন না।

হয়ত অভিনয়ের আগে উনি আরেকজন অভিনেতা পেয়ে গেছেন। কিংবা অন্য কোন মানুষ চলে এসেছে সেটে। আমার দিকে খানিকটা তাকিয়ে থপ থপ করে আমার সামনে এসে আমাকে পাজকোলা করে নিয়ে গেল ফেলল বড় টেবিলটার উপর। তারপর একটা ছুড়ি দিয়ে আমার গায়ে পড়া টিশার্ট ছিড়ে ফেলল দুই ভাগ করে।

কথা ছিল এরপর একটা ধামা নিয়ে কোঁপ দেবার আগেই ইরফন সাহেব কাট বলে শর্ট শেষ করবেন। কিন্তু কসাই বাবাজি বোধহয় ভুলে গেছে আমার টিশার্ট কাটার সময় আস্তে করে ছুড়িতে চাপ দেবার কথা। এত জোরে চাপ দিয়েছে ছুড়িতে যে আমি নিজেই বুঝতে পারছি ছুড়ির একটা কোনা লেগে আমার বুকের কাছটায় সৃষ্টি হয়েছে একটা লাল দাগ। আমি বেশ ব্যাথা পেলাম। কিন্তু এই সময় কোনভাবেই শ্বাস নেয়া যাবেনা। তাই মরার মত পড়ে রইলাম আমি।

টিশার্ট ছিড়েই হিংস্র একটা হাসি দিল কসাই। শুনেই বুকের ভেতরটা দুপদুপ করে উঠল। তারপর একটা ধামা হাতে নিয়ে ভালমত ধার পরীক্ষা করে একটা হাসি দিল সে। মাথার উপর ধামাটা ধরে কোপ দিতে যাবে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়াল কসাই- এবং শর্ট শেষ।

কিন্তু না- কাট শব্দটা কেউ চিৎকার করে আগের মত বলল না। কেউ কাট শব্দটা এখনও বলছে না। পরিচালক যদি আমার সামনে কসাইয়ের ভূমিকায় হয় তাহলে সে কেন কাট বলছে না? সে কেন আস্তে আস্তে ধামা নামিয়ে আনছে আমার ডান পায়ের গোড়ালির দিকে? কেউ কাট বলেনি –তাই ক্যামেরা রোলিং করে চলেছে। আস্তে আস্তে ধামাটা নেমে আসছে আমার পায়ের দিকে।

আমি বুঝতে পারছি কোন একটা দারুন ভুল হতে চলেছে। কিন্তু আমি মুখ নাড়াতে পারছিনা।আমি কিছু বলে ঊঠার আগেই ধামাটা এসে কোপ বসাল আমার ডান পায়ে। এবং এক কোপে আমার পায়ের একটা অংশ কেটে ফেলল কসাই। উফ তীব্র যন্ত্রনায় আমার মাথা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত কেঁপে উঠল। আমার হার্ট বিট বেড়ে গেল প্রচন্ড গতিতে। রক্তের ধারায় ভিজে গেল আমার আরেকটা পা। আমি টের পাচ্ছি গরম তরলের অবিরাম ধারা বের হয়ে যাচ্ছে আমার শরীর থেকে। কিন্তু আমি আমি কাউকে জানাতে পারছিনা।

আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে আমার দেহ। আমার দিকে আরেকবার তাকিয়ে আবার ধামা তুলে ধরল কসাই। এবার ধামাটা এগিয়ে আসছে আমার গলার দিকে। আমি শেষ বার নিঃশ্বাস নিলাম প্রাণ ভরে। ঠান্ডা বাতাসে শেষ ছোয়া এসে ভরিয়ে দিল আমার ছটফটে ফুসফুস …।

পরদিন আবার শ্যুটিংয়েরর সেট ফেলা হয়েছে এফডিসির পাঁচ নম্বর ফ্লোরে। চার নম্বর ফ্লোরে “তুমি আমার প্রেম” সিনেমার গানের শ্যুটিং হবে। তাই পাঁচ নম্বর ফ্লোরে সেট সাজানোর জন্য টিম প্রস্তুত। “কসাই” ছবির পরিচালক ইরফান খান নিজে এসে বুঝিয়ে দিলেন ডিজাইনারদের কিভাবে সাজাতে হবে। ওদের দেয়া হয়েছে চাপাতি, ধামা সহ অনেক গুলো অস্ত্র। সাথে নকল হাত,পা, রক্ত ইত্যাদি।

একটা কমবয়সী ডিজাইনার আজ এসেছে এখানে সেট সাজাবার জন্য। সে এক মনে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে একটা কাটা মাথার দিকে। প্রথমে চিনতে পারেনি। কিন্তু পরে চিনেছে এটা নতুন অভিনেতা মোরশেদ আনামের মত। যেই বানিয়েছে অবিকল বানিয়েছে।

গতমাসে মোরশেদ আনামের সাথে প্রথম পরিচয় সেট ডিজাইনারের। একটা পার্ট দেবার জন্য অনেক ধরেছিল। তাই ইরফান খানের কাছে নিয়ে গিয়েছিল সে। এই কথা গুলো ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে গিয়েছিল সে- হটাত ইসহাক সাহেবের ধমক খেয়ে মাথাটা টেবিলের উপর রেখে আবার কাজে মন দিল সে। এরপর কাটা হাত পা গুলো আংটা দিয়ে দেওয়ালের সাথে ঝুলাতে ব্যাস্ত হয়ে গেল সে …।


  ( বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সালাহ্উদ্দিন লাভলুর ধারাবাহিক নাটক 'কবুলীয়তনামা'

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ২টি গল্প

নাচো নাচো (রিমিক্স)