করোনার আক্রমণ ফুসফুসে নয়, মস্তিষ্কে হয়
করোনার আক্রমণ ফুসফুসে নয়, মস্তিষ্কে হয়
বিপুল হাসান
যা বুঝলাম মনের জোরটাই আসল, যাকে বলে মনোবল। শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম একটা ফ্যাক্টর হতে পারে.. দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার চেয়েও করোনার কামড় এড়াতে মনের দেয়ালই বেশি সহায়তা করে বলে জানিয়েছে আমার অভিজ্ঞতা। ভয়কে পাত্তা দিলেন তো গেলেন ফুরিয়ে।
আক্রান্ত হওয়ার ১৮ দিন পর করোনা নেগেটিভ এলেও, অসুস্থতা টের পেয়েছি আসলে মাত্র তিন দিন। তাও আবার একসপ্তাহের ব্যবধানে। বাসাতেই আইসোলেশনে ছিলাম ছোটভাই নিউরোসায়েন্স ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মাশফিকুল হাসানের তত্বাবধানে৷
গায়ে জ্বর ছিল। কাশিও ছিল। দেহের জোড়ায় জোড়ায় ব্যাথা ছিল। সবই সহজিয়া সহনীয় ছিল। আক্রান্তের চার কি পাঁচদিন পর ফেসবুকে করোনার কিছু টুকরো ঘটনা পড়ে আর কোয়ান্টামের বেওয়ারিশ লাশ দাফনের ছবি দেখে মনটা ভার হয়ে আসে। লখিন্দরের লোহার ঘরে সুতানালি সাপ হয়ে হানা দেয় মৃত্যুভীতি।
বিশেষ করে মারা গেলে আপনজনেরা আমার মুখটা একবারও দেখতে আসবে না, কোথায় আমার কবর হবে কেউ জানবে না। এই ভাবনাটা মগজে ভর করতেই গলায় দলাপাকানো কিছু একটা অনুভব করি। শুরু হয় কাশি আর বমি থেমে থেমে। বমির দমকে ওই দলাটা গলা থেকে বের না হয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে। বুকের ভেতর বিস্তৃত হয়, পাঁজরের হাড়ে চাপ দিয়ে যায়। নাকে সর্দি জমে, মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে হয়। এত জোরে শ্বাস টানি তাও দম পাই না।
করোনার প্রকোপে এ শ্বাসকষ্টটাই ছিল অসহনীয়। কখনো বাড়ে কখনো কমে।
মন বলে, কেউ যদি পাশে থাকে একটু ভরসা পাই। কেউ নেই৷ নিচতলার ফ্লাটে আমি একা। টলতে টলতে ওঠে গ্যাসের চুলায় নিজেই গরম পানি করি। ভাপ নিই। অতিরিক্ত গরম পানি পানে জিহ্বা পুড়িয়ে ফেলি। বাসন-কোসন সাফ করা আর ঘর মোছা সব একা একাই।
চিড়িয়াখানায় হিংস্র প্রাণীর খাঁচায় অনভিজ্ঞ কেয়ারটেকারকে কখনো মাংশ দিতে দেখেছেন? কামড় খাওয়ার ভয়ে কোনমতে মাংশের বালতিটা রেখে দ্রুত ছুটে পালায়। নিচতলার ডাইনিং স্পেসের দরোজাটা খুলে সেভাবে কিছু খাবার আর ওষুধপত্র দিয়ে আপনজনরা ছুটে পালাতো। রাগে আমার গা রি রি করে ওঠতো (যদিও পরে বুঝেছি, সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে ওটাই সঠিক ছিল)। রাগলে আবার শ্বাসকষ্ট বাড়তো আর বমিও হতো। ১০২ ডিগ্রি জ্বর নিয়েই ওই বমি আবার নিজেকেই সাফ করতে হবে, এই ভয়ে রাগ চেপে রাখি।
প্রথম দফায় দুইদিন খুব কষ্টে ছিলাম, শ্বাসকষ্ট হতো যখন ভাবতাম মৃত্যু অবধারিত। ওইসময় দুইজন মানুষ রহস্যজনক ভাবে স্বজনের চেয়েও বেশি উপকারে আসেন। নাম বললে দুজনই খেপে যাবে, তাই নাম না জানিয়েই বলি। একজন দ্রুত আমাকে প্লাজমা থেরাপি নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন, অন্যজন ধ্যান বা মেডিটেশনের কৌশল বলে দেন। আর শৈশবের কিছু বন্ধু নানাভাবে টেক্সট পাঠিয়ে আমাকে উজ্জীবিত রাখে। পূর্বপশ্চিমের শ্রদ্ধেয় সম্পাদক খুজিস্তা নূর-ই–নাহারিন মুন্নি আপাও যথেষ্ট করেছেন। ফোন করে তিনি নানারকম হেলথ টিপস দিয়েছেন, পরে সেই টিপসগুলোই দেখতাম উনার স্টাটাসে। আর পরিবারের কথা নাইবা বলি, তারা তো থাকবেই।
সবার দেওয়া সাহসে মৃত্যুভীতি কাটিয়ে উঠি। আর অবাক হয়ে লক্ষ্য করি. শ্বাসকষ্টসহ অন্যসব উপসর্গ কমতে শুরু করেছে। মনোবল ফিরে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সুস্থ হয়ে উঠি।
আইসোলেশনে আরও একসপ্তাহ কাটে। আক্রান্ত হওয়ার ১০ দিন পর শরীর আবার খারাপ করে। ম্যাসেঞ্জারে এক অবিবেচক কাছের মানুষ এমন কিছু কথা বলে, মন খারাপ হয় হতাশ হতাশ লাগে। বিস্মিত হয়ে টের পাই আবারও সেই পুরনো অনুভূতি। গলায় দলা পাকানো ব্যথা, বুকে চাপ, নাক বন্ধ হয়ে আসা আর শ্বাস নিতে একটু আধটু কষ্ট হওয়া। বুঝতে পারি করোনা আমাকে ছাড়েনি। পূর্ব অভিজ্ঞতায় বুঝে নিই, মন ভাঙা যাবে না। নিজেকে চাঙ্গা রাখতে হবে। ঘরে বসেই অফিসের কাজে মনোযোগ দেই। কাজ সবসময় আমার মনোবল বাড়ায়। এবারও তাই, কোথায় গলাব্যাথা আর শ্বাসকষ্ট, কিয়ের কি! পরদিনই ফের সুস্থ। করোনা আমাকে ছেড়ে পালালো।
আক্রান্ত হওয়ার ১৫ তম দিনে আবারও নমুনা পরীক্ষা দেই। তিন দিন পর ফলাফল এলো প্রত্যাশিত, জি.. আমি করোনামুক্ত।
এতসব বলার কারণ একটাই, প্রাণঘাতি ভাইরাসের সংক্রমণ আমাকে বলে গেছে, গোপন তত্ব। কোভিড-১৯ মানুষের ফুসফুসে সংক্রমিত হলেও কার্যত আক্রমণ করে মস্তিষ্কে। করোনা শনাক্ত হলে সাবধান, ভয়কে ঠাঁই দিবেন না। কৌশলে মনকে চাঙ্গা করেন, মনোবল ধরে রাখেন। ভার্চ্যুয়েলভাবে হলেও প্রিয়জনের সঙ্গে থাকবেন। স্বাক্ষ্য দিলাম, করোনা আপনার কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন