প্লেগ থেকে করোনা: ছয়শ’ বছরের মহামারি

 প্লেগ থেকে করোনা:  ছয়শ’ বছরের মহামারি

বিপুল হাসান



ইউরোপে চতুর্দশ শতাব্দীতে ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে আবির্ভাব হয়েছিল প্লেগ মহামারির। ওইসময় মহাদেশটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষই আক্রান্ত হয়েছিল প্লেগে। এই মহামারির কবলে পড়ে ১৪'শ শতাব্দীতে বিশ্বের জনসংখ্যা ৪৫০ মিলিয়ন থেকে ৩৭৫ মিলিয়নে নেমে আসে। প্লেগ মহামারির ছয়শ’ বছর পর পৃথিবীতে নেমে এসেছে করোনাভাইরাস মহামারি। আজকের আধুনিক বিজ্ঞান এই ভাইরাস প্রতিরোধে কোনো ভ্যাকসিন আবিষ্কারে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ। এরই মধ্যে করোনাতে মৃতের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কেউ জানে না কবে বা কিভাবে কোভিড-১৯ (করোনা) ভাইরাসের থাবা থেকে মুক্ত হবে বিশ্ব। ঠিক এমনই পরিস্থিতি হয়েছিল প্লেগ মহামারির সময়টাতে ছয়শ’ বছর আগে।

কৃষ্ণ সাগরের (ব্ল্যাক সি) উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়েছিল বলে একে বলা হতো ব্ল্যাক ডেথ। ওই সময় ইউরোপ ও এশিয়ার বাণিজ্য হতো এই কৃষ্ণ সাগর দিয়েই। আর এখান থেকে খাদ্যদ্রব্যের জাহাজগুলোতে চড়ে বসতো অসংখ্য ইঁদুর, যেগুলোকে প্লেগ রোগের প্রধান জীবাণুবাহী বলে মনে করা হয়।

১৩৪৭-৫১ খ্রিস্টাব্দ সময়কালই ছিল ব্ল্যাক ডেথের সবচেয়ে বিধ্বংসী সময়। অভিশপ্ত এই মহামারির প্রভাব অন্তত ২০০ বছর টিকে ছিল। ইতিহাসবিদগণের মতে, এ ২০০ বছরে অন্তত ১০ কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এটি এমনই এক মহামারি ছিল যে, এর কারণে সমগ্র ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থাসহ সার্বিক জীবন কাঠামোই বদলে যায়।

চৌদ্দ শতকে ইউরোপে প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে। কারো জানা ছিল না কোথা থেকে এর উৎপত্তি৷ ওই মহামারি পনেরো শতকে ইউরোপের মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগকে বিলুপ্ত করে দিয়েছিল ধরণি থেকে। কিন্তু প্লেগের জন্ম আসলে এশিয়ায়, এ মহামারী এশিয়ার দেশগুলোকে বিপর্যস্ত করে। দুর্ভাগ্যক্রমে এশিয়ায় প্লেগের মহামারি চলাকালে এসব বিষয় নথিভুক্ত করা হয়নি।

একটা সময়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ল যে ইহুদিরা পরিকল্পিতভাবে এই রোগ ছড়িয়েছে। প্লেগের পেছনে আছে ইহুদিরাই; এমন বিশ্বাস থেকে বিভিন্ন জায়গায় তাদের উপর নির্যাতন শুরু হয়। জোরপূর্বক উচ্ছেদও করা হয় অনেককে৷

ঠিক একই রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে। করোনা ভাইরাস প্রাকৃতিকভাবে নয়, তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীনের গবেষণাগারে, এমন গুজব হরহামেশাই ছড়াচ্ছে৷ ডিজিটাল যুগে যেকোন ভুল তথ্য আগের চেয়েও দ্রুত ছড়ায়৷ বিভিন্ন রোগের কারণ হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্রের গোপন জীবাণু অস্ত্র কর্মসূচির কথা বারবার সামনে আসে৷ একইভাবে এবার ষড়যন্ত্রপ্রেমীদের দাবি নভেল করোনাভাইরাস চীনের কোন গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা হয়েছে৷ সেখান থেকেই তা পরে সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে৷ কেউ কেউ দাবি করছেন যুক্তরাষ্ট্রই জীবাণুটি তৈরি করে চীনে পাঠিয়েছে৷ যদিও এসব দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই৷

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় নতুন করোনা ভাইরাসের প্রকোপ৷মানবদেহে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রথম ঘটনাটি ঘটে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের জনবহুল উহান শহরে৷ ওই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে ভাইরাসটি শনাক্ত সম্ভব হয়৷প্রথম সংক্রমণের দশদিনের মাথায় ভাইরাসটির ধরন, উৎপত্তিসহ প্রায় সব তথ্য জানা সম্ভব হয় করোনাভাইরাসের জেনেটিক কোড জানা হলেও নিজে থেকেই জিনগত গঠন পরিবর্তন করে ভাইরাসটি বার বার নতুন রূপ নেওয়ায় এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে না।

প্লেগ ছাড়ানোর সঙ্গে করোনার ছড়িয়ে পড়ার কোনো মিলই নেই। প্লেগের বাহক ছিল ইঁদুর। আর করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে মানুষ থেকে মানুষে, খুবই দ্রুততম সময়ে। তবে প্লেগের উৎপত্তি ছিল এশিয়ায়, কিন্তু আক্রান্তের হার বেশি ছিল ইউরোপে। এদিক থেকে প্লেগের সঙ্গে করোনার মিল আছে। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে কোভিড-১৯ ভাইরাসটির আবির্ভাব হলেও সেখানে করোনা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। করোনাভাইরাসের ব্যাপক বিস্তারে ঘটেছে ইউরোপে। এক ইতালিতেই করোনা আক্রান্ত হয়ে এপর্যন্ত দেড় সহস্রাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা এরই মধ্যে ইডরোপকে করোনা ভাইরাসের কেন্দ্রস্থল হিসেবে ঘোষণা করেছে। কোথায় গিয়ে এই করোনা অবরুদ্ধ হবে, তা কেউই বলতে পারছে না।

১৯৪০ সালে বিশ্বখ্যাত লেখক আলবেয়ার কামুর লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ’ প্রকাশ হয়। এতে আলজেরিয়ার ছোট্ট শহর ওরানকে পটভূমি করে প্লেগ মহামারির ভয়াবহতা আশ্চর্য নৈপুন্যের সঙ্গে তুলে ধরেন লেখক। আজকের পরিস্থিতির সঙ্গে অনেকেই কামুর লেখা উপন্যাসের মিল খুঁজে পাচ্ছেন। ওরান শহর রক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ বার বার নগরবাসীকে আশ্বস্ত করেছিল, প্লেগ প্রতিরোধে তারা প্রস্তত। কোনোভাবেই এই মহামারী শহরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। ‘সব প্রস্তুতি আছে’ এবং ‘কোন সমস্যা হবে না’ এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে ঘটনার আসন্ন ভয়াবহতাকে ছোট করে দেখা হল। কিন্তু যখন একটি ইদুঁর প্লেগ নিয়ে ঢূকে পড়লো শহরে, ভেঙে পড়লো সব প্রতিরোধ ব্যবস্থা। তিন দিনের ব্যবধানে রোগীতে ভরে গেল হাসপাতালে। মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকলো, বাড়তেই থাকলো।

আমাদের দেশের করোনা পরিস্থিতি কি সেই ওরান শহরের মতো নয়? চীন যখন থেকে করোনাভাইরাসের কথা ঘোষণা করেছে, তখন থেকেই সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠার (আইইডিসিআর) বলে আসছে, তাদের নাকি সব প্রস্তুতি আছে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো যখন পরিস্থিতি সামাল দিতে খাবি খাচ্ছে, তখন আমাদের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আমাদের সব প্রস্তুতি আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) নতুন করোনাভাইরাস জনিত রোগকে বৈশ্বিক মহামারি বলে ঘোষণা করেছে। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যবিভাগ বলে আসছে, সব প্রস্তুতি আছে! কী সেই প্রস্তুতি? সেটা ব্যাখ্যা করা হচ্ছে না।

দেশে প্রথমবার যে তিনজনকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত শনাক্ত করা হলো, তারা দেশে এসেছিলেন কোয়ারেন্টাইনে নেওয়ার একসপ্তাহ আগে। এই লম্বা সময় যেসব মানুষের সংস্পর্শে তারা এসেছেন, সেইসব মানুষদের কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া হয়েছে কিনা তা পরিস্কারভাবে জানানো হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা সবচেয়ে বড় যে বিষয়টিতে জোর দিচ্ছেন যেটা অনেক দেশ-ই করছে, সেটা হলো রোগী এবং রোগীর সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা। কিন্তু সেই কাজটা যে মোটেও ঠিকভাবে হচ্ছে না. তা বোঝা যায় করোনার প্রকোপে বিপর্যস্ত ইতালির রোম থেকে দেশে ফেরা ১৪২ জনকে নিয়ে টানাহেচঁড়ার দিকে চোখ রাখলে। সকালে কোয়ারেন্টাইনের নামে তাদের ঢোকানো হলো রাজধানীর আশকোনার হজক্যাম্পে। দেখা গেল দিনভর তারা হৈ চৈ আর বিক্ষোভ করে বেড়াচ্ছে। রাতে ঘোষণা দেওয়া হলো, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ইতালি ফেরতদের কারও দেহে করোনাভাইরাস সংক্রামনের উপসর্গ পাওয়া যায়নি বলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এত দ্রুততম সময়ে ১৪২ জনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা বোধহয় বাংলাদেশেই সম্ভব!

এসব কারণে মনে সন্দেহ জাগতেই পারে, আলজেরিয়ার ওরান শহরের বিধান-বিধাতাদের মতোই আমাদের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে উদাসীন; করোনা হুমকিকে বোধকরি তারা ছোট করেই দেখছেন!



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সালাহ্উদ্দিন লাভলুর ধারাবাহিক নাটক 'কবুলীয়তনামা'

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ২টি গল্প

নাচো নাচো (রিমিক্স)