২০০৯ সালে দেয়া সাক্ষাৎকারে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: বীরাঙ্গনা পরিচয়ে আমি গর্বিত


প্রিয় লাল-সবুজ দেশটিকে বিদায় বলে অবিনাশী জগতে চলে গেছেন মুক্তিযোদ্ধা-ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী।বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কারে প্রাপ্ত এই সংশপ্তক নারী মারা গেছেন গত ৬ মার্চ মঙ্গলবার। নির্যাতনে নুয়ে না পড়ে সৃজনশীলতার বাগানে ফুল ফোটানোর অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তিনি।গাছের শিকড়-বাকল, ডালপালা, কাঠের টুকরো ইত্যাদি ব্যবহারে তিনি গড়েছেন আশ্চর্য সব শিল্পকর্ম। কাঠের বুকে হাতুড়ি-বাটাল ঠুকে ভাস্কর্য রচনা করে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। একাত্তর নির্যাতিত এই বীরাঙ্গনার বয়ানে জাতি জেনেছে পাকিস্তানি হায়েনাদের লোলুপ বর্বরতার ইতিহাস। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যদের ভয়াবহ ধর্ষণ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনিই একমাত্র জবানবন্দি-দানকারী। স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দেয়। এর আগে ২০১০ সালে তিনি পান স্বাধীনতা পুরস্কার।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জীবনের গল্প যেন রূপকথাকেও হার মানায়। জীবদ্দশায় যে সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানিদের অমানবিক নির্যাতন সম্পর্কে প্রথম তিনি মুখ খুলে কথা বলেন, চলুন তাতে চোখ রাখি।

২০০৯ সালের ডিসেম্বরে প্রিয়ভাষিণীর ধানমন্ডির বাসায় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন বিপুল হাসান।  
পরের বছরই বীরাঙ্গনা এই শিল্পীকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়েছিল।



ধানমন্ডির তিন নম্বর সড়কটি সোজা চলে গেছে লেকের ধারে। নগরীর এদিকটায় ডেভোলপরদের কল্যাণে সারি সারি বহুতল এপার্টমেন্ট ভবন ওঠেছে। একটি বাড়িই কেবল ধরে রেখেছে তার ডুপ্লেকস কাঠামো। সবুজে ঘেরা এই বাড়িতেই বাস করছেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী৷ বাউন্ডারি ঘেরা দোতলা বাড়িটির কাঠের সদর দরোজাটি পেরিয়ে আসতেই মনে হলো, আমাদের চেনা জগতের বাইরে অন্যকোনো ভুবনে বুঝি পা রেখেছি। সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো উঠোনের এখানে সেখানে নানা আকৃতির কাঠের টুকরো। উঠোনের একপাশে গ্যারেজের মতো একটি জায়গা। এটি অবশ্য গাড়ি রাখায় এখন আর ব্যবহার হয় না। পুরো গ্যারেজ বোঝাই গাছের গুড়ি. শেকড়, শুকনো ডালপালা আর অর্ধসমাপ্ত ভাস্কর্যে। একজন কাঠমিস্ত্রি সেখনে নিবিষ্ট মনো হাতুড়ি বাটালে ঠোকাঠুকি করছেন। আর তার পাশে দাড়িয়ে নানারকম নির্দেশনা দিচ্ছেন প্রিয়মুখ প্রিয়ভাষিণী। আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন, চেনা হাসিতে অভ্যার্থনা জানিয়ে বনসাই দিয়ে সাজানো বারান্দার একপাশের বসার ঘরে নিয়ে এলেন। শুরু হলো ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর সঙ্গে কথোপকথন। মন খুলে কথা বলার আহবান জানালে তিনি শর্ত জুড়ে দিলেন- যা বলবেন তাই লিখতে হবে, কথাকে বিকৃত করা যাবে না।

# যেখানে জন্ম আর বেড়ে ওঠেছেন, সেখান থেকেই শুরু করা যাক।

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: আমার জন্ম নানাবাড়ি খুলনাতে । জন্ম তারিখ ১৯৪৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। বাড়িটির নাম বাড়ির নাম ছিল 'ফেয়ারী কুইন' বা 'পরীর রাণী'। আমার নানা এডভোকেট আব্দুল হাকিম ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের সরকারের সময় স্পিকার হয়েছিলেন। সারক্ষণ ওই বাড়িতে লোকজনের ভিড় লেগে থাকতো। আমার মায়ের নাম রওশন হাসিনা, তিনি ছিলেন পুরোপুরি গৃহিনী। বাবা সৈয়দ মাহবুবুল হক খুলনার দৌলতপুর কলেজে কমার্সের শিক্ষক ছিলেন।। ভাইবোন মিলে আমরা ছিলাম পূর্ণাঙ্গ একটি ফুটবল টিম, মোট ১১ জন। আমি হচ্ছি সবার বড়। সবাই মিলে হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে বড় হয়ে উঠি। পরে সুপ্রিম কোর্টে প্রাকটিস শুরু করায় নানা ভাই ঢাকায় আসেন এবং আমাকেও তার সঙ্গে আনেন। নানা মিন্টু রোডের বাসভবনে ওঠায় কাছাকাছি সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে ভর্তি হই। তখন শহীদ জাহানারা ইমাম ছিলেন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। পরে অবশ্য খুলনায় ফিরে গিয়ে পাইওনিয়ার গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি এবং খুলনা গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি ও ডিগ্রি পাস করি। কর্মজীবন শুরু করি শিক্ষিকা হিসেবে, ১৯৬৩ সালে খুলনার আগা খান স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি।

# আপনি সব সময় বলে থাকেন আপনার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো ১৯৭১ সাল, কেনো এই বছরটি আপনার কাছে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়।

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: কেবল আমার জন্য নয়, বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর হলো ১৯৭১।কারণ লড়াই করে রক্ত বিলিয়ে ওই বছর আমরা পাই একটুকরা স্বাধীন ভু-খন্ড। মুক্তিযুদ্ধের এ বছরটি বাঙালির কাছে তাই আজীবন স্মরণীয়। যদিও ১৯৭১ আমার জন্য দুঃস্বপ্নের একটি বছর। ষোল বছরের একটি কিশোরীর ভুলের মাশুল দিতে হয় বছরের শুরুতেই, ভেঙে যায় আমার প্রথম সংসার। মানসিকভাবে আমি যখন বিপর্যস্ত ও বেদনাহত, তখনই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের নয়টি মাস কেমন ছিল সেটা মুখে বলে যেমন বোঝানো যাবে না, তেমনি কখনোই ভুলতেও পারবো না৷ যুদ্ধ কি? যুদ্ধ হবে সেনাবাহিনীর সাথে সেনাবিহিনীর, কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধে  সাধারণ বেসামরিক মানুষের উপর পাকিস্তানি বাহিনীর যে ন্যক্কারজনক আচরণ এবং আক্রমণ, সেটা কেন? চোখের সামনে নারকীয় দৃশ্য৷ রক্ত-গুলি-লাশ। এখানে-সেখানে মা-বোনদের ধর্ষণ৷ কখনো গণধর্ষণ৷ নির্যাতনের শিকার নারীদের আর্তচিৎকার৷ আলোহীন প্রকোষ্ঠে প্রতিনিয়ত কতগুলো অসহায় নারীর মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া৷ হত্যাসহ সাধারণ মানুষের বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া- এসব কিছুই দেখেছি আমি৷ এ যেন সভ্য পৃথিবীর বাইরের অন্য কোনো জগৎ৷


# মুক্তিযুদ্ধের সময়টা তো আপনি তো খুলনা শহরেই ছিলেন। শহর ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেননি কেন?

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: পালিয়ে যাবোটা কই। যাওয়ার জায়গা থাকতে হবে না। আর তখন তো মানসিকভাবে আমি ছিলাম বিপর্যস্ত। আমার সংসার ভেঙে গেছে। সম্বল বলতে আছে ক্রিসেন্ট জুটমিলের চাকরিটা, যদিও ওটা একটা মিলের নিম্নমানের চাকরি। ওটা চলে গেলে টিকে থাকবো কিভাবে? তাছাড়া আমার উপর নির্ভরশীল ছিল আমার ছোট ভাই-বোন, আমার মা এবং আমার তিনটি সন্তান। অনেক কিছুর দায়দায়িত্ব আমার উপরে। আমার অর্থের দরকার ছিল। আমি পালানোর চিন্তা মাথায় না এনে কাজ করারই বেশি চিন্তা করেছি।

# আপনি একাত্তরে যে পরিস্থিতির মধ্যে ছিলেন, তা যদি খুলে বলতেন।

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় টিকে থাকার প্রয়োজেনে আমি একটা মিলে চাকরি নিয়েছিলাম। প্রথম সংসারটি ভেঙে যাওয়ার পর ভেঙে না পড়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছি বলেই চাকরিটা নেই। চাকরির প্রয়োজনে খুলনায় আমি একাই থাকতাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার পরিবার আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ওরা আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্টটা আমার বুকের মধ্যে থাকত তখন। মনে মনে ভাবতাম তারা কোথায় হারিয়ে গেল? আমি চাকরিজীবী তাই কোথাও যেতে পারলাম না। কিন্তু তারা গেল কোথায়? আমার তা জানা ছিল না। পরে জানতে পারি, যশোরে সীমান্তেরে একটা আশ্রয় শিবিরে তারা অিাঠে। এরকম একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমার প্রথম তিনটা মাস গেল। ওইরকম একটা পরিস্থিতিতে মানুষ মনে করল আমি একা। সুতরাং চারিদিকে যেভাবেই হউক খবর হয়ে গেল যে আমি ২৩ বছর বয়সের একটি মেয়ে ওইরকম প্রতিকূল অবস্থায়ও চাকরি করছি। সুযোগ সন্ধানীরা আমার কাছে পাত্তা না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠলো। অবাঙালিরা সুযোগটা কাজে লাগালো।

# পাকিস্তানি সৈন্য ধর্ষণ করছে, নারী নির্যাতন করছে- ওই অবস্থায় আপনি কম বয়সী একটি মেয়ে হয়ে খুলনা শহরে থাকার ঝুঁকি নিলেন?

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: অবিশ্বাস্য মনে হলেও ওইসব একেবারেই আমার কানে আসেনি। একা একা থাকতাম, লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা আর মেলামেশা কম করতাম। কেউ আমাকে সাবধান বা সতর্ক করেনি। আর তখন তো মিডিয়া এরকম জাগ্রত ছিল না, এত মিডিয়াও ছিল না। একটা টিভিও কারও বাসায় ছিল না। একটি টেলিফোন করতে হলে পিসিও (পাবলিক কল অফিস) থেকে করতে হতো। কল দিয়ে বহুক্ষণ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থেকে কথা বলতে হতো। সামনে যে আমার বিপদ, আমাকে কে টেলিফোন করে জানাবে? পরিস্থিতিটা তখন এমনই ছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিক থেকেই নারী নির্যাতন শুরু হলেও সেন্সরশিপের কারণে পত্র-পত্রিকায় ওসব আসেনি। আর ওই সময় তেমন কারও সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না। সারাদেশে যে কী চলছে, বোঝার কোন উপায় নাই। মনে হয় যেন আমি একাই বোধহয় এরকম নির্যাতিত হয়ে চলছি। সারাদেশে যে নারী নির্যাতনের বিষয়টি উত্তাল হয়ে পড়েছে তা বুঝতে পারিনি। এবং ওই বয়সে বুঝতামও না যে, নারী নির্যাতন কী। সংসার ও স্বামীর সঙ্গে গন্ডগোল তখনই- সেটা সামাল দিব, না নির্যাতিত যে হচ্ছি সেটা সামাল দিব? আসলে কোনটা যে নারী নির্যাতন তা’ বুঝে উঠতে পারছিলাম না। নির্যাতনকেই স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়ে নির্যাতিত হয়েছি।

# প্রথম নির্যাতনের পরে কী আপনি মিল থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছেন বা করতেন?
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: চেষ্টা তো করেছি কিন্তু পারিনি। কারণ একদিকে আমার চাকরি, ওভারটাইম, বেতন। মাকে মাসে মাসে টাকা পাঠানো। নিজের বাচ্চাদের টাকা পাঠানো। এসবের জন্য বের হতে পারিনি। তারা ছিল যশোরের আশ্রয় কেন্দ্রে। তাদের বাঁচানো আমার দায়িত্ব।

# আপনার মা, ভাই -বোন কি জানতেন কর্মক্ষেত্রে অবাঙালীরা আপনাকে নির্যাতন করছে?
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: না। ওরা জানত না। কিছুই জানত না। আমিও জানাতাম না। কারণ উনাদের জানিয়ে লাভটা কী হবে? উনারা তো তখন আর আমাকে রক্ষা করতে পারবেন না। ওদেরও যে একটা বেঁচে থাকার দরকার, ওরাও মরবে, আমিও মরব। সবাই মরবে। তার থেকে আমি নির্যাতিত হচ্ছি তাই ভালো। এজন্য আমার ওপর ধারাবাহিকভাবে চলা অবাঙালি ও পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতন সম্পর্কে তাদেরকে জানাইনি।


# জুট মিলে কিভাবে নির্যাতিত হয়েছেন?

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: মুক্তিযুদ্ধকালে যে জুট মিলে চাকরি করতাম তার নাম ক্রিসেন্ট জুটমিল, সেটার মালিক ছিল অবাঙালিরা। আমার ধারণা ছিল, অবাঙালি বলেই এখানে ঝামেলামুক্ত কাজ করা যাবে। অথচ আমি একসময় মিলে বন্দি হয়ে পড়ি। ওই চাকরিতে কর্তৃপক্ষের চাপে আমাকে প্রতিনিয়ত এন্টারটেইন করতে হতো বহু আর্মি অফিসারকে। আমাকে রীতিমত নির্যাতিত হতে হত। বহু আর্মি অফিসার, আর্মিদের যারা সহযোগিতা করেছিল সেসমস্ত কর্মীদের, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মনোরঞ্জনে আমাকে ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের চোখে, প্রত্যেকের ভাষায় সেই যুদ্ধের সময়টায় ছিল একটাই ভাষা- যৌন নিপীড়ন। একই ভাষা, একই দৃষ্টি। একটা মানুষও আমাকে মায়া করেনি। আমাদের বাঙালিরাও ওই সময়ের সুযোগটা নিল। কারণ, ওরাও তখন বুঝে ফেলে যে আমি খুব বিপন্ন পরিস্থিতিতে কাটাচ্ছি।

# আপনি পালানোর চেষ্টা করেননি কেনো?

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: কিভাবে পালাবো, কোথায় পালাবো? পালিয়ে কই যাবো। পালাতে পারছিলাম না। মাকে তো টাকা দিতে হবে। ভাই-বোনকেও দিতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি তখন আমি পালাতে চেষ্টা করিনি। করে লাভ কী? ওইপাড়ে (ভারতে) যেয়ে আমাকে দেখবে কে? আমার হাতে তো টাকা পয়সা থাকবে না। আমি কোন্ নষ্ট লোকের পাল্লায় পড়লেও আমার অবস্থা আরও খারাপ হবে হয়ত। এখন তো তাও কিছু হলে অফিস সাপোর্ট দিবে। তখন তো অফিসও নাই। আমি তো একেবারেই পুরো নিষিদ্ধ পল্লীতে চলে যাব। কম বয়স তো। এ সময় সব মেয়েরই চেহারা -টেহারা একটু ভালো থাকে। আমার জীবনটাই তখন নষ্ট হয়ে যাবে। যাই হোক সেই পরিস্থিতিকে আস্তে আস্তে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। সবই ভাগ্যের লিখন হিসেবে মেনে নিলাম।

# এরকম নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও আবার কেনো আপনাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নেওয়া হলো?


ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: সেটা সত্যিই এক রহস্য।আমার সঙ্গে মুক্তিদের কানেকশন আছে, এই অভিযোগটা কেউ একজন পাকিস্তানি সেনা অফিসারদের কানে পৌছে দেয়। অক্টোবরের শেষের দিকে আমাকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই রাতে ফিদাইর (উচ্চ পদস্থ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা) চিঠি নিয়ে ক্যাপ্টেন সুলতান, লে. কোরবান আর বেঙ্গল ট্রেডার্সও অবাঙালি মালিক ইউসুফ এরা আমাকে যশোরে নিয়ে যায়। যাওয়ার পথে গাড়ির ভেতরে তারা আমাকে ধর্ষণ করেছে। ৩২ ঘণ্টা আমাকে আটকে রাখা হয়েছিল। এমন কোনো নির্যাতন নেই, যা তারা করেনি। আমার জীবনে সে এক দুঃসহ স্মৃতি। যোনিপথে গরম ডিম প্রবেশ করিয়ে ভিকটিমের আর্ত-চিৎকার শুনে উল্লাস করা কি কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব। কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আমার সঙ্গে তাই করা হয়েছিল নির্মম, নৃশংস নির্যাতনের পর এক পর্যায়ে আমার বোধশক্তি লোপ পায়। ২৮ ঘণ্টা চেতনাহীন ছিলাম।
এখন নিজেকে সান্তনা দেই এই ভাবে যে, আমরা ছিলাম এই রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে নিরন্তন সাক্ষী। এতদিন হয়ত সমাজের ভয়ে নিজেকে একটু গোপন করে রেখেছিলাম। এখন আমার কাছে মনে হয় সমাজ একটা সাধারণ চেতনা। সমাজ কোন ব্যাপারই না, কিন্তু সেই সমাজের ভয়েই অর্থাৎ ওই বিষয়টি নিয়ে মনের মধ্যে সব সময় একটা অকারণ ভয় কাজ করত তাই সেই সমাজে সামাজিক ভয়ে নিজেকে এতদিন লুকিয়ে রেখেছিলাম।কিন্তু আজকে সে বিষয়টা আমার কাছে খুব গর্বের বিষয় মনে হয়। ওইসময়ের নির্যাতন এখনো আমার মনে দাগ কাটে। আমি ভাবি ১৯৭১সালে কত নির্মমভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়েছে, তারা শহীদ হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন। অনেকে জীবন বাজি রেখেও মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। আমিনিজেকে ওইখানে নিয়ে ভাবলে আমারও তেমন গর্ব হয় এই ভেবে যে, তখন আমার উপরওে এবং আমাদের নারী সমাজের উপর নির্যাতন করা হয়েছে। তাই সব কিছু মিলিয়ে অর্থাৎ আহত মুক্তিযোদ্ধা এবং ১৯৭১-এ শহীদ মুক্তিযোদ্ধার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা রেখে বলতে পারি যে আমরাও তখন তাদের পাশে ছিলাম।


# স্বাধীনতার পর কি পরিস্থিতিতে পরলেন?


ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: একাত্তরে আমি পেয়েছি দৈহিক যন্ত্রণা, শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছি। আর স্বাধীনতার পর স্বাধীন দেশে পেয়েছি মানসিক যন্ত্রণা। দীর্ঘ সময় একাই পথ পাড়ি দিতে হয়েছে আমাকে। মা প্রগতিশীল এবং ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও যুদ্ধ শেষ হলে অনেকটাই একা হয়ে পড়ি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক গঞ্জনা, অপবাদ সইতে হয়েছে আমাকে। আমি একটা খারাপ মেয়ে, আমি চরিত্রহীন- সবাই তাই মনে করতো। এরই মধ্যে একসময় আমি আবিষ্কার করলাম দুই মাসের না তিনমাসের কনসিভ।সাংঘাতিক বিপদজ্জনক পরিস্থিতি! জানিনা কে? কার দ্বারা? কীরকম ভয়ংকর। মাথার ঘাঁয়ে কুকুর যেমন পাগল হয়ে দৌড়ে বেড়ায়। আমিও তেমন ঘরের মধ্যে ছিলাম। আর বলছিলাম আল্লাহ আমাকে বাঁচাও। আল্লাহ আমাকে বাঁচাও। আমি কার কাছে যাব? এমআর আমি টাকা কোথায় পাব?আমি পাগলের মত হয়ে গেলাম। আমি কোথায় পাব টাকা? তখন এমআর করার জন্য দৌড়াদৌড়ি করছি। শেষে সুদে ৫০০ টাকা যোগার করে এম আর করাই।
একাত্তরের পরের বছরগুলোতে বুকের মধ্যে উত্তাল যন্ত্রণার ঢেউ আছড়ে পড়ছিল, কখনও সবার আড়ালে নিজের একান্ত প্রান্তে এসে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছি। খুঁজে ফিরেছি সামাজিকভাবে আমার বারবার অসম্মানিত হওয়ার সঠিক কারণগুলো। উত্তর সহজেই মিলেছিল। স্বাধীনতার মহান যুদ্ধের আমি পলে পলে সাক্ষী। নয়টি মাসের কলংক মুছে ফেলে আমি সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। অসাড় সমাজকে প্রবল আঘাতে প্রত্যাখ্যান করে মহান স্বাধীনতার মূল্যবোধে নির্মাণ করতে সচেষ্ট ছিলাম। আমার সৃজনে সান্ত¡না, মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত চেতনা আমার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। এখন আমার মনে হয়, এই যুদ্ধে আমরা যারা অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছি, তাদের সবারই পুনর্জন্ম লাভ হয়েছে। আমি তখন ২৩ বছরের তরুণী। তিন সন্তানের জননী। ঘর-গৃহস্থালী আর একটি জুট মিলে চাকরি করি। রাজনৈতিক পরিবারে থাকলেও আমি এসবের কিছুই বুঝতাম না। মা রওশন আরার কাছে যেটুকু শুনতে পেতাম সেটুকুই আমরা রাজনৈতিক জ্ঞান। তবে স্বদেশের প্রতি যে ভালোবাসা সেটা অকথিত ভাষা, যা আমার প্রাণেমনে সঞ্চিত চিরজাগ্রত। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে স্কুলের শিশুরা গান করে আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি'। ভাবতে বুকটা আনন্দে ভরে ওঠে। আমরা স্বাধীন বাংলার গান গাইছি। ৩০ লাখ মানুষের আত্মদানে হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সূর্যোদয়।।



# পাকিস্তানিদের হাতে নির্যাতিত হওয়ার বিষয়ে কেনো মুখ খুললেন?

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: ধারণা ছিলো, আমার বক্তব্য শুনে আরো অনেকে এগিয়ে আসবে। বেরিয়ে আসবে দানবীয় সব খটনা। বাস্তবে তা দেখা যায়নি। পরবর্তীকালে খুব কম সংখ্যক নারী একাত্তরের ভয়াবহতা তুলে ধরার সাহস করতে পেরেছিলেন।আসলে তাদেরকে বোঝাতে হবে নিজেদেরকে বীরাঙ্গনা হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জার কিছু নেই। এটা তাদের জন্যই গর্ব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার গর্ব। লাখো লাখো মানুষ দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। আমরাও দেশের জন্য এই ত্যাগ স্বীকার করেছি। এতে লজ্জার কিছু নেই। .আমি নিজে বীরাঙ্গনা পরিচয়ে গর্বিত

# বীরাঙ্গনা কী মূল্যায়ন বা সম্মান পাচ্ছেন?

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী: না মূল্যায়ন পাচ্ছে না। আমি অন্তত দেখিনি কাউকে মূল্যায়ন করতে। কয়েকজন ভালো গৃহিণীকে আমি চিনি। তাদের সাথে যুদ্ধের পরে এয়ারপোর্টে আমার দেখা হয়েছিল। তারা আমার কাছে বিশেষভাবে রিকোয়েস্ট করেছে আমি যেন তাদের নামটা না বলি। সুতরাং আমি কথা দিয়েছি যে আমি জীবনেও বলব না। তাই এখনও বলিনি আমি যা হারিয়েছি তা কোন দিনও পূরণ হবে না। ইতিহাসেও সেই অপূর্ণতা থেকে যাবে। তবে সবার কথা জানিনা, আকস্মিক হউক আর যেভাবেই হোক সৌভাগ্যবশত সামগ্রিকভাবে সমস্ত সমাজ আমার অভিমান ভাঙাতে পেরেছে। যেহেতু আমি কারও কাছে কোনপ্রতিদান চাই না তাই কষ্ট পাই কম। প্রতিদান যদি চাইতাম তাহলে অনেক কষ্ট বাড়ত। প্রতিদান না চাওয়ার ফলে একটা জিনিস হয় যেমনটা সবসময় শান্তই থাকে। বিক্ষিপ্ত হয় না যে আমাকে ওটা দিল না, বা কেউ এটা বলা উচিত ছিল বলল না। কারও কাছে কিছু না চাওয়ার মধ্যে শান্তি খুঁজে পাই।

[সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ পাক্ষিক আনন্দ আলোতে প্রকাশিত হয়েছিল]

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সালাহ্উদ্দিন লাভলুর ধারাবাহিক নাটক 'কবুলীয়তনামা'

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ২টি গল্প

নাচো নাচো (রিমিক্স)