মানবাধিকার দিবস এবং আজকের বাংলাদেশ



:: আমির ইউসুফ ::

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস ১০ ডিসেম্বর। ১৯৪৮ সালের এই দিনে ঘোষিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ, যার মূল ভিত্তি ছিল মানুষের মর্যাদা, নিরাপত্তা ও মানবসত্তার স্বীকৃতি।  তবে ১৯৫০ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে এক রেজুলেশনের মাধ্যমে ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা পায়। সেই থেকে দিনটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে মানবাধিকার দিবস হিসেবে। বাংলাদেশে সরকারিভাবে দিবসটি পালিত না হলেও মানবাধিকার সংস্থাগুলোসহ অনেক বেসরকারি সংগঠন দিবসটি পালন করছে।

এ বছর বিশ্ব মানবাধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হল হিউম্যান রাইটস ৩৬৫। অর্থাৎ বছরের ৩৬৫ দিনই মানবাধিকার দিবস। এই বিশেষ দিনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতি চোখ রাখা যাক।

স্বাধীনতা অর্জনের আগে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী হরণ করেছে এদেশের মানুষের অধিকার, পদদলিত হয়েছে মানবাধিকার। পরাধীন দেশে অধিকার আদায়ের দাবিতে বার বার ফুঁসে ওঠেছে বাংলার মানুষ, প্রাণ বিলিয়েছে অকাতরে। অসীম সাহসী এদেশের মানুষ গর্জে ওঠেছে মুক্তিযুদ্ধে, ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে সীমাহীন আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। গণতন্ত্র, সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ আর একটি মর্যাদাবান জাতি গঠনের প্রত্যয়ে প্রণীত হয়েছে সংবিধান।

এদেশের মানুষ এমন প্রগতিশীল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছে- যেখানে সব নাগরিকের থাকবে সমান অধিকার, প্রতিষ্ঠিত হবে আইনের শাসন, নিশ্চিত হবে সুবিচার, থাকবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। দূর্ভাগ্যজনকভাবে মানুষের সেই স্বপ্ন-আশা স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও কোনো সরকারই করতে পারেনি নিশ্চিত। আজও এদেশের মানুষের কাছে মানবাধিকার যেন এক দূরাশা।


চিন্তা, বিবেক ও মতামত প্রকাশের যে স্বাধীনতার অধিকারের ঘোষণা সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ এবং আমাদের মূল সংবিধানে রয়েছে, তাতে প্রথম বাধা আসে মূল সংবিধান গৃহীত হওয়ার ১ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। ১৯৭৩ সালে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধানাবলী সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে জরুরি অবস্থা বিদ্যমান থাকাকালীন জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো হরণ করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর কমবেশি ১০ বছর সামরিক শাসনামলে এবং ২০০৭-০৮ সময়কালে সেনাসমর্থিত নির্দলীয় সরকারের আমলে জনগণ এ জরুরি বিধানাবলীর শিকার হয়ে তাদের মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত থাকেন। ভবিষ্যতেও যে তারা এরূপ বঞ্চনার শিকার হবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মূল সংবিধানে প্রজাতন্ত্র হবে গণতন্ত্র মর্মে যে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তা হোঁচট খায়। বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্থলে প্রতিষ্ঠিত হয় একদলীয় শাসন। প্রত্যক্ষভাবে বা অবাধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নিজ দেশের সরকারে অংশগ্রহণের অধিকার প্রত্যেকেরই রয়েছে মর্মে সর্বজনীন মানবাধিকার সনদে ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যেমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ সম্পর্কিত বিধানটুকু বিলুপ্ত করা হয়। বিচার বিভাগ তার অনেক ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পরপরই ৪টি ছাড়া অন্যসব দৈনিক পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়। জনগণের বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় সম্প্র্রচার নীতিমালা-২০১৪-এর কঠোর সমালোচনা করেছেন সম্পাদক পরিষদ, গণমাধ্যম কর্মীসহ অনেকে। বলা হয়েছে, এই নীতিমালা গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করবে, গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করবে।



বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি দিন দিন অবনতিই হয়েছে। বতর্মান সময়ে তা চরম বিপর্যয়ে পৌছে গেছে। সহিংসতা, পাশবিকতা, নির্মমতা, অমানবিকতা ও নীতিহীনতায় সমাজকে চরম অস্থিরতা ও অস্থিতিশীল করে তুলছে। হরহামেশা  দিন-দুপুরে গুম-খুনের শিকার হচ্ছে মানুষ। বছরের পর বছর ধরে যারা গুম হয়ে আছেন তাদের উদ্ধারে কোন তৎপরতা নেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সদস্য পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আর তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোন কোন ক্ষেত্রে মাস খানেক নিখোঁজ থাকার পর মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে হাজির করা হচ্ছে। ক্রসফায়ারও চলছে সমানতালে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকার পরও কথিত ক্রসফায়ারে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় আসামির ওপর নির্যাতন হচ্ছে। নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশের হামলা ও শক্তিপ্রয়োগের ঘটনা ঘটছে অহরহ। ধরে নিয়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলির ঘটনাও ঘটছে প্রায়ই। নিরপরাধ মানুষকে বানানো হচ্ছে সন্ত্রাসী। সীমান্তেও চলছে সমানতালে খুন-অপহরণ। নারীর প্রতি সহিংসতার বিকৃত বীভৎস ঘটনা ঘটছে একের পর এক। সুবিচার চাইতে গিয়ে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ অবস্থার খন্ড চিত্র ওঠে আসছে প্রতিদিনের গণমাধ্যমগুলোতে। জাতির বিবেক হিসেবে চিহ্নিত গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের জন্য একের পর এক চালানো হচ্ছে পাঁয়তারা।

সহিংসতায় খুন হচ্ছে সন্তান কর্তৃক বাবা-মা, ভাই কর্তৃক ভাই-বোন, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী, প্রেমিক কর্তৃক প্রেমিকা এমনকি প্রেমিকার মা-বাবাও। হাজার হাজার খুন, হত্যাকান্ড ঘটছে ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিজমা ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে। রাজনৈতিক নির্যাতন ও দমনমূলক কর্মকান্ডে গুম ও অপহরণ এক নতুন মাত্রা সংযোজন করছে।

চলতি বছর আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে খুন হয়েছে ৩ হাজার ৬১ জন। রাজধানীতে ১৭২ জন। তাদের মধ্যে ১০ জন খুন হয়েছেন রাজনৈতিক কারণে। বাকি ১৬২ জনই সামাজিক ও পারিবারিক কারণে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত ৫ বছরে সারা দেশে খুন হয়েছে ২০ হাজার ৬৮০ জন। র‌্যাব কর্তৃক নারায়ণগঞ্জে চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনা, ঝালকাঠির লিমন হত্যাচেষ্টা। ২০১১ সালে চট্টগ্রামের মন্দির থেকে কোটি টাকা লুট- স্বর্ণকার মৃদুলের কাছ থেকে ৮০ তোলা স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয়া, চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার তালসারা দরবার শরিফ থেকে ২ কোটি টাকা আত্মসাতসহ বহু ঘটনা রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক সংঘটিত হওয়ার প্রত্যক্ষ প্রমাণ।

আটকাবস্থায় খুন ও আইনবহির্ভূত হত্যা আগেও সংঘটিত হলেও গুমের ব্যাপকতা লক্ষ করা গেছে সাম্প্র্রতিক সময়ে। বলতে গেলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমল থেকে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ১৫০ ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন। ৩১ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে দেশে ২২৯ ব্যক্তি গুমের শিকার হয়েছেন।

মানবাধিকার কর্মী ও বিশিষ্টজনেরা বলছেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বর্তমানে উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে।

দেশে একটি মানবাধিকার কমিশন রয়েছে। জনগণের কাছে এটির পরিচয় নখদন্তহীন বাঘ হিসেবে। সুশীল সমাজ ও জনগণের অভিযোগ, কমিশন আইন অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। মানবাধিকার লংঘন প্রতিরোধে নেয়নি কোনো উদ্যোগ। নির্বিকার থেকে এটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১৪ সালের রিপোর্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে এক নেতিবাচক চিত্র ফুটে উঠেছে। এতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর সরকারের নির্যাতন ও দমননীতির বিশদ বিবরণ রয়েছে।

এ অবস্থায় বাংলাদেশে মানবাধিকার দিবস পালন এক হাস্যকর আনুষ্ঠানিকতা বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিকরা।

# ০০:১২, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সালাহ্উদ্দিন লাভলুর ধারাবাহিক নাটক 'কবুলীয়তনামা'

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ২টি গল্প

নাচো নাচো (রিমিক্স)