অনলাইনে জুয়ার ফাঁদ, নিঃস্ব হাজারো মানুষ
তথ্যপ্রযুক্তির আশীর্বাদ একদিকে যোগাযোগ-কেনাকাটাসহ অনেক কিছুই হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে, অন্যদিকে এর অপব্যবহার অনেকের জীবনে সর্বনাশের গাঢ় ছায়াও ফেলেছে। সেই সর্বনাশা ছায়াটি হলো অনলাইন জুয়া। বাংলাদেশে জুয়া নিষিদ্ধ, তবুও তা চলছে। বিশেষ করে অনলাইনে জুয়াখেলা ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। প্রতারণার এই ফাঁদে হাজারো মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। একবার এই ফাঁদে পা রাখলে প্রলোভনের জাল ছিড়ে বের হয়ে আসা খুবই কঠিন।
অনলাইনে জুয়া চলে সহজলভ্য অ্যাপসের মাধ্যমে।যে কেউ চাইলেই তার স্মার্ট ফোনে অ্যাপ আপ করে কিংবা ব্রাউজারে লিংক ব্যবহার করে অ্যাকাউন্ট খুলে এই জুয়ার আসরে ঘরে বসেই যোগ দিতে পারে। এতে লেনদেন হয় মোবাইল ব্যাংকিং অর্থাৎ বিকাশ, নগদ বা রকেটের মাধ্যমে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন বা এজেন্টদের পোস্টের মাধ্যমে অনলাইনে জুয়ার ফাঁদ পাতা হয়। লোভের ফাঁদে ফেলতে সোশাল মিডিয়ায় ডেমো অ্যাকাউন্টে কয়েকগুণ বেশি লাভ দেখিয়ে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। লোভ দেখানো হয় লাখপতি হওয়ার! অ্যাপসগুলোতে এমনভাবে সফটওয়ার সাজানো থাকে, যাতে শুরুতে হয়তো সামান্য লাভ পাওয়া যায়। পরে আরো লাভের আশায় যখন কেউ আরও টাকা বিনিয়োগ করে তখনই শুরু হয় লুটে নেওয়া। হারানো টাকা ফিরে পাওয়ার আশায় আরো খেলতে গিয়ে মানুষ আরো বিপদে পড়ে। একসময় সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। অনেকেই কৌতূহল থেকে এ খেলা শুরু করার পর এতে এমনভাবে জড়িয়ে যাচ্ছেন যে, আর বের হতে পারেন না। প্রথমে লাভবান হয়ে পরবর্তী সময়ে লোভে পড়ে একপর্যায়ে খোয়াচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। জুয়ার কারণে বাড়ছে পারিবারিক অশান্তি, মানসিক বিষণ্নতা, দাম্পত্য জীবনে কলহ। খেলার টাকা জোগাড় করতে বাড়ছে অপরাধ। বাড়ছে নৈতিক অবক্ষয়। এই সর্বনাশা অনলাইন জুয়ার নেশায় বিপন্ন পরিবার, সমাজ—এমনকি রাষ্ট্র।
অনলাইন জুয়ায় আসক্ত বেশির ভাগই স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ তরুণ প্রজন্ম। অবশ্য বয়স্কদেরও এখন এই খেলা খেলতে দেখা যায়। এমনকি গ্রাম এলাকার অনেক শ্রমজীবীমানুষ তাদের মজুরিটুকুও এই পথে নষ্ট করছেন।লোভে পড়ে লাভের আশায় অনেকে ধারকর্জ করছেন, নিজের শেষ সম্বল জমিটুকুও বিক্রি করে দিচ্ছেন। পরে সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। অনলাইন জুয়ার আসক্তি মাদকের আসক্তির চেয়েও প্রবল ও ক্ষতিকর।
অনলাইনে জুয়া দেশের জন্যও হয়ে ওঠেছে মারাত্মক অশনিসংকেত। কারণ এইসব সাইটের সফটওয়্যারসহ মূল মালিকানা থাকে বিদেশিদের হাতে। বিশেষ করে চীন, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে অনলাইনে জুয়ার সাইটগুলো পরিচালিত হয়। দেশে কিছু এজেন্ট তাদের সহায়তা করে থাকে। এসব এজেন্টের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে রিচার্জ করা টাকা অবৈধভাবে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। যার ফলে বেড়ে যাচ্ছে মুদ্রাস্ফীতি। অনলাইন জুয়ায় বিদেশে পাচার হচ্ছে বছরে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্খ।
এই অনলাইন জুয়ার আগ্রাসন রুখতে না পারলে চরম বিপর্যয় নেমে আসবে দেশে। সরকার অবশ্য এরই মধ্যে এ বিষয়ে তৎপর হয়েছে। বিটিআরসির রিপোর্ট অনুযায়ী, সম্প্রতি ৩৩১টি জুয়ার সাইট দেশের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই বন্ধ করাটাও কার্যকর থাকছে না। কারণ প্রতারক চক্র প্রতিটি অ্যাপস বা সাইটে বিকল্প কয়েকটি আইপি ব্যবহার করে থাকে। একটা বন্ধ হলে আরেকটা আইপি দিয়ে বা নাম পরিবর্তন করে তারা নতুনভা্বে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাই এ বিষয়ে দরকার, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ধারাবাহিক অভিযান এবং কঠোর নজরদারি।
অনলাইন জুয়া বন্ধে সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার. সেটা হলো জনসচেতনতা। সামাজিকভাবে অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে, জুয়ার ক্ষতিকর নানাদিক। কিভাবে এটি মানুষকে নিঃস্ব করে দেয়, তা তুলে ধরতে হবে। ঘরে ঘরে ব্যাপক সচেতনতা আর সরকারের কঠোর তৎপরতায় নির্মুল করা সম্ভব অনলাইন জুয়ার সর্বগ্রাসী আগ্রাসন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন