যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায়, ঘুচালো আরেকটা কলংক

যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায়, ঘুচালো আরেকটা কলংক


প্রস্তুতি: জাতীয় (প্রতিমুহূর্ত.কম)

অবশেষে বৃহত্তর ময়মনসিংহের আলবদর বাহিনীর প্রধান কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল।

সকাল ১১ টা ২০ মিনিটে শুরু হওয়া কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ৬২ পৃষ্ঠার সারসংক্ষেপ শোনার পর, গণহত্যাও নির্যাতনসহ ৭টি অভিযোগের মধ্যে ৩ ও ৪ নং অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুপুর ২টায় এ রায় দেন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক। ৫ ও ৬ নং অভিযোগ পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবের কারণে প্রমাণিত হয়নি।

মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের এই প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতন, দেশত্যাগে বাধ্যকরাসহ ৭ ধরনের অপরাধের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছিল।

১ নম্বর অভিযোগ-প্রসিকিউশনের অভিযোগে বলা হয়েছে, কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সময় ২৯ জুন শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী থানার কালীনগর গ্রামে ফজলুল হকের ছেলে বদিউজ্জামানকে রামনগর গ্রামের আহম্মদ মেম্বারের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা।

এরপর তাকে নির্যাতন করে আহম্মদনগরের রাস্তার ওপরে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে লাশ টেনে নিয়ে কাছাকাছি কাঠের পুলের নিচে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়।

২ নম্বর অভিযোগ- মে মাসের মাঝামাঝি এক দুপুরে শেরপুর কলেজের তৎকালীন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে খালি গায়ে মাথা ন্যাড়া করে, গায়ে ও মুখে চুনকালি মাখিয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে নগ্ন অবস্থায় চাবুক দিয়ে পেটাতে পেটাতে শেরপুর শহর ঘোরায় আসামি কামারুজ্জামান ও তার সহযোগীরা।

৩ নম্বর অভিযোগ-একাত্তরের ২৫ জুলাই ভোর বেলায় কামারুজ্জামানের পরিকল্পনা ও পরামর্শে রাজাকার, আলবদরসহ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার সোহাগপুর গ্রাম ঘিরে ফেলে। এরপর তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ১২০ জন পুরুষকে ধরে এনে হত্যা করে। ধর্ষণের শিকার হন গ্রামের মহিলারা।

৪ নম্বর অভিযোগ- ১৯৭১ সালের ২৩ অগাস্ট মাগরিবের নামাজের সময় গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। কামারুজ্জামানের নির্দেশে তাকে সুরেন্দ্র মোহন সাহার বাড়িতে বসানো আলবদর ক্যাম্পে রাখা হয়।

মোস্তফার চাচা তোফায়েল ইসলাম এরপর কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করে তার ভাতিজাকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেন। কিন্তু ওই রাতে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা গোলাম মোস্তফা ও আবুল কাশেম নামের আরেক ব্যক্তিকে মৃগি নদীর ওপর শেরি সেতুতে নিয়ে গিয়ে গুলি করে।

গুলিতে গোলাম মোস্তফা নিহত হলেও হাতের আঙ্গুলে গুলি লাগায় নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান আবুল কাশেম।


৫ নম্বর অভিযোগ-একাত্তরে রমজান মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক সন্ধ্যায় শেরপুরের চকবাজারের বাসা থেকে মো. লিয়াকত আলী ও আরো ১১ জনকে আটক করে ঝিনাইগাতী আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। এরপর তিনজন ছাড়া বাকি সবাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

গুলি করার সময় আসামি কামারুজ্জামান ও তার সহযোগী কামরান সেখানে উপস্থিত ছিলেন বলে অভিযোগ করেছে প্রসিকিউশন।

৬ নম্বর নির্যাতন- একাত্তরের নভেম্বর মাসে দিদারসহ কয়েকজনকে ময়মনসিংহ শহরের জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় ধরে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। পাকিস্তানের পক্ষে বক্তব্য দিতে বাধ্য করতে সেখানে নির্যাতন চলে তাদের ওপর।


৭ নম্বর অভিযোগ-একাত্তরে ২৭ রোজার দিন দুপুরে টেপা মিয়ার বাড়ি ঘেড়াও করে আলবদর বাহিনী। এরপর কামারুজ্জামানের নির্দেশে টেপা মিয়াসহ ৫ জনকে হত্যা করা হয়।

আনুষ্ঠানিক অভিযোগের বিবরণ অনুযায়ী, কামারুজ্জামান এসব অপরাধ করেছেন একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে। তার বিচরণক্ষেত্র ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা।

বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ১১টার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর এজলাসকক্ষে ২১৫ পৃষ্ঠার রায়ের সংক্ষিপ্তসার (৬২ পৃষ্ঠা) পাঠ শুরু হয়। সকাল ১১টা ৫ মিনিটে কামারুজ্জামানকে এজলাসকক্ষে তোলা হয়। এরপরই এজলাসে বসেন তিনজন বিচারক। চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারক প্যানেলের সদস্য শাহিনুর ইসলামের আদালতে এ বিচারকাজ শেষ হয়েছে গত ১৬ এপ্রিল।

বিচারক শাহিনুর ইসলাম রায়ের প্রথম অংশ পড়ে শেষ করেন। তার পর দ্বিতীয় অংশ পড়েন বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া। দুপুর সোয়া ১টার দিকে তৃতীয় অংশ পড়া শুরু করেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। রায়ের মোট ৬৫১টি অনুচ্ছেদ।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনাল-২-এ নেওয়া হয়। এদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তাকে বহনকারী মাইক্রোবাসটি ট্রাইব্যুনালে পৌঁছে। আগের দিন সন্ধ্যার দিকে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সশস্ত্র বিরোধীতাকারী, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযুক্ত জামায়াতের এই নেতাকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয়।


আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনলের ৪র্থ রায় হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বরণীয় হয়ে থাকবে এই রায়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সালাহ্উদ্দিন লাভলুর ধারাবাহিক নাটক 'কবুলীয়তনামা'

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ২টি গল্প

নাচো নাচো (রিমিক্স)