জসীম উদ্দীনের কাব্যে পল্লী মাটির সোঁদা ঘ্রাণ
''এই খানে তোর দাদির কবর ডালিম-গাছের তলে
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।
এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।
এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,
সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা! ''
জসীম উদ্দীন
যখন কবিতা লিখেছেন তার সমসাময়িক কবিরা কেউ কবিতার অন্তঃমিল খুঁজে হয়রান
হচ্ছিলেন না। কেউ খুঁজছিলেন না কবিতার আবহমান ছন্দের দুলুনি। তারা কবিতা
লিখছেন অক্ষরবৃত্তের নেতানো নম্রতায়, প্রায় গদ্যের টোনে। আর জসীমউদ্দীন
টান টান ছন্দে মাত্রাবৃত্ত-স্বরবৃত্ত প্রয়োগ করেছেন। দিচ্ছেন তাল মেলানো
অন্তঃমিলের ঝঙ্কার। ফলে জসীমউদ্দীনকে তরুণেরা খানিকটা ভুলের ভেতর ফেলতেই
পারেন। ভুল বললাম এ কারণে জসীমউদ্দীনের সমসাময়িক কবিদের পথ একেবারে
মাড়ালেন না তিনি। তাদের ধারে-কাছে ঘেঁষলেন না। তাদের স্পর্শ এমনকি গন্ধও
নিলেন না। সম্পূর্ণ আলাদা পথের পথিক তিনি।
একা। একক শক্তিতে তিনি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ এবং বাংলাদেশের আবহমান গ্রামীণ জীবনের চিত্র ছন্দবদ্ধ করেছেন। লিখেছেন গ্রাম নিয়ে। গ্রামের চিরন্তনতা নিয়ে। চর ও চরের সহজ সরল সাধারণ মানুষের জীবনপদ্ধতি ও যাপিত জীবন নিয়ে। অন্য কবিরা যেখানে নাগরিক বিষয়-আশয় নিয়ে ব্যস্ত। সেখানে জসীমউদ্দীন সম্পূর্ণ গ্রামমুখী।
একা। একক শক্তিতে তিনি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ এবং বাংলাদেশের আবহমান গ্রামীণ জীবনের চিত্র ছন্দবদ্ধ করেছেন। লিখেছেন গ্রাম নিয়ে। গ্রামের চিরন্তনতা নিয়ে। চর ও চরের সহজ সরল সাধারণ মানুষের জীবনপদ্ধতি ও যাপিত জীবন নিয়ে। অন্য কবিরা যেখানে নাগরিক বিষয়-আশয় নিয়ে ব্যস্ত। সেখানে জসীমউদ্দীন সম্পূর্ণ গ্রামমুখী।
যেখানে অন্য কবিরা আন্তর্জাতিক
ঘটনাপ্রবাহের ভেতর উড়াল তুলছেন, জসীমউদ্দীন সেখানে বাংলাদেশের মাটির গন্ধে
বিভোর। এই যেখানে পরিস্থিতি, সেখানে জসীমউদ্দীন আলাদাই হবেন। হবেন একাকী। এ
তো বলারই অপেক্ষা রাখে না। রাখে না বলেই জসীমউদ্দীন একক এবং একজনই। এবং
তিনি একজন হিসেবেই থাকবেন।
এখন প্রসঙ্গ হচ্ছে জসীমউদ্দীনকে তরুণেরা কেন আধুনিক বলতে দ্বিধা করছে? কেন বলছে তিনি গ্রাম্য কবি! কেন বলছে তিনি আধুনিক নন! তিনি কি গ্রাম্য ভাষায় কবিতা লিখেছেন? এ প্রশ্নের জবাব সরাসরি না। যদি না হয়ে থাকে তবে তিনি কিভাবে গ্রাম্য কবি হলেন! গ্রাম নিয়ে লিখেছেন বলে? এ প্রশ্নের জবাব যদি হ্যাঁ হয় তবে বলতে হবে এখানে মূর্খতা আছে। আছে অজ্ঞতা। অজ্ঞতা এবং মূর্খতা নিয়ে একজন কবির বিষয়ে সুবিচার করা যাবে না। যায় না। সুবিচার না করা মানেই জুলুম। আর জুলুম তো মেনে নেয়া চলে না। কেন মানব! সত্যের সাথে সহবাস কারার অধিকার তো যেকোনো পাঠকের রয়েছে।
অনেক তরুণের একটি প্রবণতা রয়েছে অস্বীকারের। অস্বীকারের মাধ্যমে তারা নিজেকে জাগিয়ে রাখতে চায়। প্রতিষ্ঠা করতে চায় আমি সব বুঝি। বলতে চায় আমি বড় হয়েছি। আমি নতুন কিছু করছি। আমি এমন কিছু বুঝি যা আগের কেউ বোঝেনি। এমন কিছু করি যা অন্য কেউ করেনি। সুতরাং আমি এখন একটা কিছু। আমাকে গ্রাহ্য করতে বাধ্য। মানতে হবেই। না মানলেই সে অনাধুনিক অথবা ব্যাক ডেটেড।
হ্যাঁ
এ কথা সত্য, তরুণেরাই তো নতুন কিছু করবে। নতুন কিছু লিখবে। নতুন আনন্দের
প্রতিষ্ঠা করবে। নতুন অস্তিত্বে জাগিয়ে তুলবে ভবিষ্যতের পথ। কিন্তু তার
মানে এ নয় কোনো প্রতিষ্ঠিত লেখককে অস্বীকার করতে হবে। বলতে হবে অমুক
আধুনিক নয়। অমুক গ্রাম্য কবি।
জসীমউদ্দীন গ্রাম নিয়ে লিখেছেন। লিখেছেন গ্রামের সহজ সরল মানুষের জীবনযাপন নিয়ে। লিখেছেন গ্রামের বিশাল আকাশ ও উদার প্রকৃতির সৌন্দর্য নিয়ে। কিন্তু তিনি লিখেছেন নাগরিক ভাষায়। তিনি নগরজীবনের মানুষ। তিনি পুরোটাই নাগরিক। তার বিশেষত্ব হলো তিনি গ্রামকে নগরে নিয়ে এসেছেন।
নাগরিক করে তুলেছেন উদার
প্রকৃতিকে। গ্রাম্য ভাষা তিনি গ্রহণ করেননি। গ্রহণ করেছেন গ্রামকে। গ্রামের
প্রকৃতির সারল্য তিনি নাগরিক ছন্দে স্পন্দিত করেছেন। তিনি বাংলাদেশকে
গেঁথে দিয়েছেন তার কবিতার শরীরে। তার কবিতা থেকে বেরিয়ে পড়ে দো-আঁশ
মাটির গন্ধ। বিস্তীর্ণ ধানের জগৎ যেন তার কবিতা। সমগ্র বাংলাদেশকে তিনি তার
কবিতায় চিত্রিত করেছেন।
যে ক’জন কবি দেশের মাটি ও মানুষকে পুঁজি করেছেন জসীমউদ্দীন তাদের মধ্যে অন্যতম। তাদের সেরাদের একজন। তিনি দেশকে কিভাবে বুকের গভীরে লালন করেছেন তার কবিতা ঠোঁটে নিলেই বোঝা যায়। কতটা গভীর থেকে ভালোবেসেছেন দেশ এবং দেশের মাটিকে। মাটির মন্ত্রণা তাকে যে চেতনা দিয়েছে তা-ই তিনি এঁকেছেন তার কবিতায়। তা দিয়েই তিনি দিয়েছেন কবিতার অন্তঃমিল। নির্মাণ করেছেন ছন্দের জগৎ। তিনি ছন্দে লিখেছেন। অন্তঃমিল দিয়েছেন। দিয়েছেন বলেই তিনি আজো বাংলাদেশের পাঠক হৃদয়ে জেগে আছেন সম্মানের সাথে। নিত্য পঠিত তিনি। তিনি পাঠ্য প্রতিদিন। তাকে স্মরণ করতেই হয়। ফিরতেই হয় তার দিকে।
তিনি জানতেন তার দিকে ফিরতে হবে এ দেশের পাঠককে। তাকে স্মরণ করতে হবে। তাকে পাঠ করতে হবে। তার অন্তঃমিলের স্বাদ নিতেই হবে। একে বলে কবির আত্মবিশ্বাস। এ বিশ্বাস দৃঢ় করতে হয়। জসীমউদ্দীনের এ দৃঢ়তা ছিল। দৃঢ়তার সাথে, আস্থার সাথে লিখেছেন তিনি।
তার এ আস্থায় কখনো চিড় ধরেনি। অত্মবিশ্বাস হারাননি তিনি। তিনি নিজেকে জানতেন। নিজের শক্তি সম্পর্কে অবগতি ছিল তার। ফলে তার ভেতরের বিশ্বাস ছিল আশ্চর্য রকম শক্তিমত্তার। তাকে নিয়ে সমালোচনা আজো যেমন রয়েছে, তার সমসাময়িক কালেও ছিল। কেউ কেউ তাকে সরাসরি জিজ্ঞেসও করেছেন। কেউ আবার লিখে নিয়েছেন এক হাত। কিন্তু তিনি কিছুই পরোয়া করেননি। কিছুই কানে তোলেননি। আবার এর জন্য মাড়াননি ঘৃণা কিংবা হিংসার মতো অসুন্দর পথ। বরং তিনি ঋজু ভাষায় তার সমস্ত শক্তি দিয়ে জোড়া দিয়েছেন অন্তঃমিল। নির্মাণ করেছেন ছন্দের পৃথিবী। তার ছন্দের ঝঙ্কার কার না কানে বাজে। কার না হৃদয়ে লাগে। কেউ যদি কবিতায় বাংলাদেশ খোঁজেন তো তাকে খুঁজতেই হবে।
প্রবেশ
করতে হবে তার কবিতার দুনিয়ায়। তার ছন্দের আনন্দঘন পৃথিবীতে। এখানেই
জসীমউদ্দীনের অহঙ্কার। এ অহঙ্কার ছিল তার সারাজীবন। এ অহঙ্কার নিয়েই চলতেন
তিনি। তাকে যতটা উদ্ধার কার যায় তিনি তার সাধনায় ছিলেন সতত তৎপর এক
ধ্যানী। এক অসাধারণ মগ্নতার পথিক। তিনি কবিতাকে মগ্নতার ভেতর আবিষ্কার
করেছেন। নির্মাণ করেছেন ধ্যানের অখণ্ড গভীরতায়। যার জন্য তার কবিতা পাঠ
করলেই হৃদয়পটে জীবন্ত হয়ে ওঠে চিত্রকল্প। মনে হয় এই বুঝি দেখা যায়। এই
বুঝি যায় স্পর্শ করা। একজন কবির এটি বড় সাফল্য। বড় অর্জন।
একজন কবিকে রচনা করতে হয় নিজস্বতা। নিজস্ব বৈশিষ্ট্য না দাঁড়ালে কবি হয়ে যান কমন। কমন কবির সংখ্যা তো সীমাহীন। জসীমউদ্দীন কমন কবি নন। তার রয়েছে নিজস্ব জগৎ। নিজস্ব ভাষা ও নিজস্ব চেতনা। এমনকি তার অন্তঃমিলের ঢঙও নিজস্বতায় ভাস্বর। তিনি যা দেখেছেন এবং দেখে বিশ্বাস করেছেন তাই লিখেছেন। এবং লেখার ক্ষেত্রে কারো সমালোচনার ধার তিনি ধারেননি। কেন? কারণ তিনি কি লিখছেন তা তিনি জানতেন। তার বিশ্বাসের জায়গাটা ছিল অত্যন্ত গভীর।
সুতরাং জসীমউদ্দীন আধুনিক কবি নন, এ কথা বলা হয় মূর্খতা না হয় জ্ঞানপাপ। যারা কাউকে উপেক্ষা করতে চান তারা তো যেকোনো ছুতানাতা ধরতেই পারেন। জসীমউদ্দীনের ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। তাকে উপেক্ষা করতে চাইলে যা ইচ্ছে তা তো বলাই যায়। কিন্তু কেউ বললেই তা সত্য হয়ে যাবে তেমন ভাবার কোনো কারণ তো ঘটেনি।
উপেক্ষা যিনি করেন তাকেও তো উপেক্ষা করা যায়। আমরা তাই করি। জসীমউদ্দীন আমাদের বাংলাদেশকে প্রণের গভীর থেকে তুলে এনেছেন কবিতায়। তাই তার কবিতা প্রাণস্পর্শী। তার কবিতা হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়। দৃশ্যকে জাগিয়ে দেয়। দৃশ্যকল্প হাজির করেন বাস্তবতার নিরিখে।
গাছের
ছায়ায় লতায় পাতায়/মোর শিশুকাল লুকায়েছে হায়। এ কথা বলার শক্তি থাকা
চাই। শক্তিহীন রিক্ত যারা, যারা কবিতার পৃথিবীতে প্রবেশ করার যোগ্যতা
অর্জনে ব্যর্থ তারা অনেক দায়িত্বহীন উচ্চারণে অভ্যস্ত হতেই পারেন। তাদের
মনে রাখতে হবে দায়িত্বহীনতা কোনো কোনো দায়িত্বশীল লোক গ্রহণে আগ্রহী হবেন
না।
জসীমউদ্দীন আগাগোড়া একজন আধুনিক কবি। তিনি আমাদের গ্রামকে, গ্রামের প্রকৃতিকেও আধুনিকতায় জাগিয়ে দিয়েছেন। তাই তাকে পাঠ করতেই হবে। তাকে নিতে হবে হৃদয়ের কাছে। হৃদয় সে কথাই তো বলে। হৃদয়ের সাথে সম্পৃক্ত না হলে কবিতা হবে কী করে। কবিতার জন্য হৃদয় চাই। হৃদয়ের জন্যও দরকার কবিতা। জসীমউদ্দীন এ দুটোকেই প্রশ্রয় দিয়েছেন। দুটোকেই মান্য করেছেন তিনি। ফলে তিনি আধুনিক জটিল নাগরিক জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। গ্রহণ করলেন গ্রামীণ নির্মল আনন্দের পৃথিবী। এবং তাকেই তিনি চিরদিনের করে নিলেন তার কবিতায়। যার থেকে বেরিয়ে আসে পল্লী মাটির সোঁদা ঘ্রাণ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন