এমনেস্টির রিপোর্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ চিত্র

প্রস্ততি : আন্তর্জাতিক (প্রতিমুহূর্ত.কম)

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বার্ষিক রিপোর্টে বাংলাদেশে গত বছর সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ২৩ মে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় ভোর পাঁচটায় লন্ডনে অ্যামনেস্টির বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৩ প্রকাশ করা হয়। এতে বিশ্বের ১৫৯টি দেশের গত বছরের (২০১২) সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে।
 
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ পরিস্থিতির বিবরণে বিনা বিচারে ৩০ জনকে হত্যা, ১০ জনের গুম এবং অনেকগুলো নির্যাতনের ঘটনায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।


রিপোর্টে বলা হয়, গত বছর বাংলাদেশে ৩০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে এবং কমপক্ষে ১০ জন গুম হয়েছে। নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। রাজনৈতিক সহিংসতায় কমপক্ষে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। মহিলাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। সরকার বাঙালি বসতি স্থাপনাকারীদের হামলা থেকে উপজাতিদের নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে। অগ্নিকান্ডে ১১১ পোশাক শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছে।

কর্মকর্তারা ভবন ত্যাগের অনুমতি না দেয়ায় এসব শ্রমিক মারা গেছে। সাম্প্রদায়িক হামলায় ২০টির বেশি বৌদ্ধমন্দির ও  বৌদ্ধবিহার, একটি হিন্দু মন্দির, বৌদ্ধদের বেশকিছু ঘরবাড়ি ও দোকানপাট ভস্মীভূত হয়েছে। একজনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে এবং কমপক্ষে ৪৫ জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত জানুয়ারিতে বলেছিলেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। গত ডিসেম্বরে বিরোধী দলগুলো দিনব্যাপী হরতাল পালনের চেষ্টা করলে রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। কমপক্ষে ৪ জন নিহত হয় এবং কয়েক ডজন বিক্ষোভকারী ও পুলিশ আহত হয়।

জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি তাদের নেতৃবৃন্দের মুক্তি দাবি করছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি করছে। সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি গ্রুপের সদস্যরা বিরোধী দলের কর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে এবং একজন পথচারীকে পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে।

গত বছরের জুনে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে সরকার সাড়া দানে ব্যর্থ হলে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা বাতিল করে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িত থাকায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান চালাচ্ছে। সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশিদের হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সরকার ভারতের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ অব্যাহত রেখেছে।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডে গত বছর বাংলাদেশে কমপক্ষে ৩০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে। পুলিশ দাবি করছে যে, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এসব লোক নিহত হয়েছে। অন্যদিকে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো দাবি করছে, সাদা পোশাকের লোকজন গ্রেফতার করার পর তাদের হত্যা করা হয়। সাদা পোশকধারীরা নিজেদের হয়তো র‌্যাপিড একশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) বা পুলিশের লোক বলে পরিচয় দিয়েছে। এসব হত্যাকান্ডের জন্য কাউকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।

র‌্যাব গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ায় কৃষক আতাউর রহমানকে (তোফা মোল্লা) গুলি করে হত্যা করে। র‌্যাব দাবি করেছে, ‘ক্রসফায়ারে’ আতাউর রহমান নিহত হয়েছে। অন্যদিকে আতাউরের পরিবারের সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, আগের দিন সন্ধ্যায় র‌্যাব তাকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। তার শরীরে গুলির তিনটি ক্ষত দেখা যায়। দুটি ক্ষত ছিল পিঠে।

নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার
পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আটককৃতদের ওপর নির্যাতন চালায় এবং তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। বন্দিদের ওপর  নির্যাতনের জন্য দৃশ্যত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়মুক্তি ভোগ করছে। নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে প্রহার, লাথি, খাদ্য গ্রহণ ও ঘুমাতে না দেয়া এবং ইলেক্ট্রিক শক দেয়া। অপরাধের ‘স্বীকারোক্তি’ দেয়া নাগাদ অধিকাংশ আটককৃতদের নির্যাতন করা হয়। পুলিশ ও র‌্যাব নির্যাতনের প্রমাণ গোপন রাখতে গ্রেফতারের তারিখসহ সকল রেকর্ড বিকৃত করে।

গুম
গত বছর কমপক্ষে ১০ জন গুম হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। উদ্ধারকৃতদের শরীরে প্রহারে আঘাতের চিহ্ন ছিল। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী গত বছরের ১৭ এপ্রিল তার গাড়িচালক আনসার আলীসহ নিখোঁজ হন। সরকার ঘটনার তদন্ত করার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বছরের শেষ নাগাদ কোনো তথ্য দেয়নি।

মহিলা ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা
মহিলারা বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়। এসব সহিংসতার মধ্যে ছিল এসিড নিক্ষেপ, যৌতুকের দাবি মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় স্ত্রীকে হত্যা, কথিত ব্যভিচারের অভিযোগে গ্রাম্য সালিশে দোররা মারা, স্বামীর হাতে নির্যাতন এবং যৌন নিপীড়ন।

গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর বিনা পরোয়ানায় আলেয়া বেগম ও তার কন্যাকে গ্রেফতার করা হয় এবং কুষ্টিয়া জেলায় কুষ্টিয়া থানায় তাদের ওপর নির্যাচন চালানো হয়। আলেয়া বেগমের মেয়ে একজন কলেজছাত্রী। দুদিন পর তাদের কুষ্টিয়া সিটি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেখানে তাদের অন্ধকার রুমে আটক রাখা হয়। কলেজছাত্রী কন্যাকে মায়ের কাছ থেকে পৃথক করা হয় এবং পুলিশ এ কলেজ ছাত্রীর ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। আদালতে হাজির হওয়ার পর  ১৮ সেপ্টেম্বর তাদের মুক্তি দেয়া হয়। স্থানীয় একটি পত্রিকায় তাদের ওপর নির্যাতনের সংবাদ প্রকাশিত হলে ২৬ সেপ্টেম্বর ফের আলেয়া বেগম ও তার মেয়েকে গ্রেফতার করা হয়।

শ্রমিকদের অধিবার
স্বল্প বেতন ও কাজের অসন্তোষজনক পরিবেশের প্রতিবাদে পোশাক শ্রমিকরা আন্দোলনে নামলে নেতৃবৃন্দকে হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়। এতে একজন নিহত হয়। গত বছরের ৪ এপ্রিল শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম নিখোঁজ হন। একদিন পর ঢাকার গাবতলীতে তার লাশ পাওয়া যায়। আমিনুলের পরিবার তার লাশে নির্যাতনের প্রমাণ দেখে বিশ্বাস করছে যে, নিরাপত্তা বাহিনী তাকে অপহরণ করেছে। ট্রেড ইউনিয়ন তৎপরতায় জড়িত থাকায় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সদস্যরা তাকে আগেও গ্রেফতার করেছিল। অগ্নিকান্ড এবং অন্যান্য আঘাতে কমপক্ষে ১১১ পোশাক শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছে। ঢাকার সাভারে গত বছরের নভেম্বরে তাজরিন ফ্যাশন্সে অগ্নিকান্ডের সূচনা হলে কর্মকর্তারা বের হতে না দেয়ায় এসব শ্রমিকের মৃত্যু হয়।

 আরএম : ২৩/৫-৩

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সালাহ্উদ্দিন লাভলুর ধারাবাহিক নাটক 'কবুলীয়তনামা'

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ২টি গল্প

নাচো নাচো (রিমিক্স)