২০দিনেও উদঘাটন হয়নি পান্থ হত্যাকান্ডের রহস্য

প্রস্তুতি : সারাদেশ (প্রতিমুহূর্ত.কম)

বন্ধুদের ফোন, বাড়ির পাশে খেলার মাঠ, পড়ার টেবিলে বইয়ের পাতা, কম্পিউটারের মাউস, ফেসবুক একাউন্ট, শোয়ার ঘরের বিছানা, দামি সানগ্লাস-পারফিউম, বিদেশ যাওয়ার পাসপোর্ট, আলনায় সাজানো সারি সারি জামা-কাপড়, মায়ের মমতা, বাবার  স্নেহ, বোনের ভালোবাসা আর কোন কিছুই পান্থকে ফিরিয়ে আনবেনা না-ফেরার দেশ থেকে।

এখন সেখানে শুধু কান্না এবং স্মৃতি, আর এ নৃশংস হত্যাকান্ডের বিচারের দাবিতে বারবার বিবেকের দরজায় আঘাত হানে মানব সভ্যতা। হয়তো সেদিন নরঘাতক পিশাচরা যখন রক্তের হলি খেলায় উল্লাস করছিলো তখন কাতর কন্ঠে নতজানু হয়ে তাদের কাছে প্রানভিক্ষা চেয়েছিল পান্থ। কিন্তু কোন কিছুই তাদের কঠিন হৃদয়কে বিগলিত করতে পারেনি সেদিন।

এমন নির্মম, বর্বর, অমানবিক হত্যাকান্ডের ঘটনায় পান্থর পবিবারের প্রতিটি মানুষ এখন এক একটি কংক্রিটের দেয়ালে পরিনত হয়েছে। এখন সেখানে শুধু ছেলের ছবি বুকে জড়িয়ে, ফিরে আয় বাবা বলে মায়ের আর্তনাদ। শেষ সম্বল হারিয়ে বাবার কান্না, প্রতিবন্ধী ভাইয়ের অবুঝ হাসি, বোনের নির্বাক তাকিয়ে থাকা- সব যেন বিবর্ণ এক রংধনু।

সরেজমিনে শুক্রবার ভোলা শহরের চরনোয়াবাদে নিহত ভোলা সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র হাসনাইন কবির পান্থর বাড়িতে গেলে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। পান্থ হত্যাকান্ডের ঘটনার ২০দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এর কোন রহস্য উদঘাটন করতে না পারায় হতাশ পরিবারের সবাই। অন্যদিকে এমন হত্যাকান্ডের ঘটনায় তার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে বলে জানায় এলাকাবাসী।

ছেলের ছবি বুকে জড়িয়ে পান্থর মা হোসনেয়ারা বিউটি জানান, সেদিন রাতে ছেলের জন্য খাওয়ার টেবিলে ভাত রেখে অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। এরপর রাত ১০টা পেরলে পান্থর মুঠো ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেন। এসময় ফোনটি কেটে দিলে মা ভাবেন ছেলে বাড়ির কাছেই রয়েছে। এখই চলে আসবে। কিন্তু আরো সময় কেটে যায়। বন্ধ হয় মুঠো ফোন। নিখোঁজ হয় পান্থ। শুরু হয় পরিবারের নির্ঘুম রাত। শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। বন্ধুবান্ধব-আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি, হাসপাতাল, থানা কোথাও নেই পান্থ। রাত গড়িয়ে সকাল, সকাল গড়িয়ে দুপুর-সন্ধ্যা। কেটে যায় আরও একটি দুঃস্বপ্নের রাত। এরপর আবার সকাল আসে ভয়াবহ সংবাদ নিয়ে। এসব কথা বলতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন পান্থর মা।

পান্থ’র মামা সাংবাদিক নীরব মোল্লা জানান, নিখোঁজ হওয়ার ২দিন পর পান্থর খবর মিলে। সেখানে ছুটে যান তারা। হাত-পা বাধাঁ পেটকাঁটা পান্থর বিভৎস লাশ দেখে আঁতকে ওঠেন। তিনি আরো জানান, পান্থর মত রাজনীতি বিমূখ, সহজ সরল একটা ছেলেকে কেউ হত্যা করতে পারে এটা বিশ্বাস হওয়ার মতো নয়। ব্যক্তিগত জীবনে পান্থর বন্ধুদের সাথেও কোন বিবাদের কথা আমাদের কানে আসেনি। এ কারণে আমরা কাউকে সন্দেহ করতেও পারছিনা। তবে পুলিশের ভূমিকা আমাদের পরিবারকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ভোলার মত ছোট জায়গায় এ ধরনের একটি নৃশংস হত্যাকান্ড ঘটিয়ে যদি হত্যাকারিরা পার পেয়ে যায়, তাহলে তারা ভবিষ্যতে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব এ হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনের জন্য পুলিশের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

পান্থর বাবা পৌর ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হুমায়ুন কবির মোল্লা জানান, হত্যাকান্ডে ঘটনার সময় তিনি আমেরিকা ছিলেন। পান্থর আমেরিকা যাওয়ার সকল কাগজ ও টাকা জমা দেয়া শেষ হয়েছিল। ছেলে পান্থর আমেরিকা যাওয়া ছিলো সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর সেই ছেলের নৃশংস হত্যাকান্ডে তিনি অনেকটা ভেঙে পড়েছেন।

পান্থ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোঃ আব্দুর সালাম জানান, হত্যাকান্ডে জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তারকৃত আসামী সুমনকে ১৯মে আদালত ফের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

এ ব্যাপারে ভোলা জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বলেন, হাসনাইন কবির পান্থ হত্যাকান্ড বিষয়টি আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। আমরা টেকনিক্যাল ও ননটেকনিক্যাল দুই দিক দিয়েই বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি। সার্বক্ষনিক তদন্ত করার জন্য মামলাটি ইতিমধ্যেই পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে হস্তান্তর করা হয়েছে। এরই মধ্যে দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তবে এ হত্যাকান্ডে এদের সংশ্লিষ্টতা এখনো প্রমানিত হয়নি। আশা করি খুব শিগগিরই আমরা এ মামলার রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হব। পুলিশ সুপার আরো বলেন, পান্থের কাছে থাকা লক্ষাধিক টাকার মোবাইল ফোন আত্মসাতের জন্য এ হত্যাকান্ড ঘটতে পারে।

উল্লেখ্য, গত ৪মে রাতে পান্থকে দুর্বৃত্তরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। এর দু’দিন পর ৬মে সকালে উত্তর চরনোয়াবাদ এলাকার খাল থেকে পান্থ’র লাশ উদ্ধার হয়। সেদিন বিকেলে নিহতর চাচা গোলাম কবির বাদি হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। হত্যাকান্ডে জড়িত সন্দেহে রাতেই সুমন নামে একজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।

এরপরে ৮মে রাতে কৃষ্ণা নামে অপর এক ব্যাক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৯ মে সুমনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালত সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। ১৪ মে পান্থ হত্যা মামলাটি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে হস্তান্তর করা হয়। এর পর ১৯ মে আদালত ফের সুমনকে আরো সাত দিনের রিমান্ড দেয়। তবে ঘটনার ২০দিন পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এ হত্যাকান্ডের কোন রহস্য বের হয়নি। তার কাছে থাকা লক্ষাধিক টাকার মোবাইল ফোনের জন্য তাকে বন্ধু বা পরিচিত কেউ হত্যা করতে পারে বলে ধারনা পুলিশের।

প্রতিবেদন : অচিন্ত্য মজুমদার, জেলা প্রতিনিধি, ভোলা
সম্পাদনা : হাসান ইমাম, বিভাগীয় সম্পাদক, সারাদেশ

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সালাহ্উদ্দিন লাভলুর ধারাবাহিক নাটক 'কবুলীয়তনামা'

পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ২টি গল্প

নাচো নাচো (রিমিক্স)